পুড়ে
কয়লা হয়ে গেছে গলায় রশি বাঁধা দুটি গরু। ধান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
এখানে-সেখানে পড়ে আছে গৃহস্থালি নানা সামগ্রী—সব পোড়া। ঘরের আশপাশে থাকা
গাছের নারকেলগুলো পর্যন্ত পুড়ে গেছে। ভস্মীভূত ঘরগুলোর নানা জায়গা থেকে
(ঘটনার ২৭ ঘণ্টা পর) ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
এই চিত্র বরিশালের চর কাউয়ার কালীখোলা গ্রামের পণ্ডিতবাড়ির। এক দিন আগেও যাঁদের বাড়িঘর ছিল, গতকাল শনিবার সেই হিন্দুদের পাওয়া গেল ত্রাণের লাইনে। বাড়িঘর, সহায়-সম্বল হারানো নয়টি হিন্দু পরিবারের পুরুষেরা জেলা প্রশাসনের দেওয়া টাকা আর ঢেউটিন নিতে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। নারী ও শিশুরা তখনো আহাজারি করছে।
গত বৃহস্পতিবার ব্যাডমিন্টন খেলা নিয়ে দুই দল যুবকের ঝগড়া হয়। ঝগড়া থেকে রক্তক্ষয়ী মারামারি। সেখানে পারভেজ নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। আহত তিনজনের মধ্যে একজন ঢাকায় মারা গেছেন—গত শুক্রবার সকালে এই গুজবে ভর করে আক্রমণ করা হয় হিন্দুপাড়ায়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় নয় হিন্দু পরিবারের সর্বস্ব। ফায়ার সার্ভিস ও গ্রামবাসী মিলে দুপুরে সেই আগুন নেভান। তবে ২৭ ঘণ্টা পরও গতকাল বেলা আড়াইটায় সেখানে দেখা গেল, ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে।
হিন্দু পরিবারগুলোর অভিযোগ, তাদের বাড়িঘরগুলোতে আগুন দেওয়ায় সময় সেখানে মাত্র চারজন পুলিশ সদস্য মোতায়েন ছিলেন। অতিরিক্ত পুলিশ থাকলে এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলে এ ঘটনা এড়ানো যেত বলে মনে করছে তারা।
এই চিত্র বরিশালের চর কাউয়ার কালীখোলা গ্রামের পণ্ডিতবাড়ির। এক দিন আগেও যাঁদের বাড়িঘর ছিল, গতকাল শনিবার সেই হিন্দুদের পাওয়া গেল ত্রাণের লাইনে। বাড়িঘর, সহায়-সম্বল হারানো নয়টি হিন্দু পরিবারের পুরুষেরা জেলা প্রশাসনের দেওয়া টাকা আর ঢেউটিন নিতে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। নারী ও শিশুরা তখনো আহাজারি করছে।
গত বৃহস্পতিবার ব্যাডমিন্টন খেলা নিয়ে দুই দল যুবকের ঝগড়া হয়। ঝগড়া থেকে রক্তক্ষয়ী মারামারি। সেখানে পারভেজ নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। আহত তিনজনের মধ্যে একজন ঢাকায় মারা গেছেন—গত শুক্রবার সকালে এই গুজবে ভর করে আক্রমণ করা হয় হিন্দুপাড়ায়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় নয় হিন্দু পরিবারের সর্বস্ব। ফায়ার সার্ভিস ও গ্রামবাসী মিলে দুপুরে সেই আগুন নেভান। তবে ২৭ ঘণ্টা পরও গতকাল বেলা আড়াইটায় সেখানে দেখা গেল, ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে।
হিন্দু পরিবারগুলোর অভিযোগ, তাদের বাড়িঘরগুলোতে আগুন দেওয়ায় সময় সেখানে মাত্র চারজন পুলিশ সদস্য মোতায়েন ছিলেন। অতিরিক্ত পুলিশ থাকলে এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলে এ ঘটনা এড়ানো যেত বলে মনে করছে তারা।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত: পুলিশ ও
গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার বিকেলে চর কাউয়া সরকারি
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে কালীখোলা গ্রামের বিকাশ হালদার, পীযূষ চন্দ্র
হালদার, শান্ত চন্দ্র হালদারসহ কয়েকজনের সঙ্গে চর আইচা গ্রামের সমবয়সী
পারভেজ গাজী, শামীম গাজী ও জহিরুল ইসলামরা ব্যাডমিন্টন খেলছিলেন। সেখানে
খেলা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়।
একপর্যায়ে দুই দলের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায় এবং
কালীখোলা গ্রামের যুবকেরা চর আইচা গ্রামের পারভেজ গাজীকে (২২) ধারালো
অস্ত্র দিয়ে কোপান। বাধা দিতে গেলে পারভেজের ছোট ভাই পাভেল গাজী (১৮),
গ্রামের শামীম গাজী ও জহিরুল ইসলামকেও কোপানো হয়। বৃহস্পতিবার রাতেই
তাঁদের বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসকেরা
পারভেজ গাজীকে মৃত ঘোষণা করেন। আর জহিরুলের অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ঢাকা
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পারভেজ গাজী বরিশাল বিএম কলেজে
হিসাববিজ্ঞানে দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন।
গতকাল দুপুরে পারভেজের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পরিবারের
সবাই শোকাচ্ছন্ন। বাবা সেলিম গাজী অভিযোগ করেন, ক্রিকেট খেলা নিয়ে কিছুদিন
আগে পীযূষ, শান্ত, শ্যামল, ধীমানসহ কয়েকজনের সঙ্গে তাঁর ছেলের হাতাহাতি
হয়েছিল। ওই ঘটনাকে মাথায় রেখে বৃহস্পতিবার ব্যাডমিন্টন খেলার সময়
পরিকল্পিতভাবে পারভেজকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
বরিশাল মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মুজাহিদুল ইসলাম জানান,
খবর পেয়ে রাতেই চর কাউয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পুলিশ পাঠানো হয়।
আটক করা হয় ধীরেন্দ্র চন্দ্র হালদার (৫০), পীযূষ চন্দ্র হালদার (২০) ও
শান্ত চন্দ্র হালদারকে (২৬)।
সকালে গুজবের পর হিন্দুবাড়িতে আগুন:
স্থানীয় লোকজন জানান, পারভেজ হত্যার ঘটনায় রাতে এলাকায় উত্তেজনা চলছিল।
শুক্রবার সকালে নিহত পারভেজের পরিবার ও চর আইচা গ্রামের লোকজন রাস্তায়
নেমে আসেন। সকাল ১০টার দিকে ক্ষুব্ধ জনতার মধ্য থেকে হঠাৎ গুজব ওঠে, ঢাকায়
চিকিৎসাধীন জহিরুল ইসলাম মারা গেছেন। এই গুজবে ভর করে কয়েক হাজার মানুষ
হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া শুরু করে। আগুন দেওয়ার আগে মূল্যবান
জিনিসপত্র লুটপাট করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা।
কালীখোলা গ্রামটি কীর্তনখোলা নদীর পূর্ব পাড়ে। আর পশ্চিম
পাড়ে বরিশাল শহর। খবর পেয়ে বরিশাল থেকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি গিয়ে
এলাকাবাসীর সহায়তায় দুপুরে আগুন নেভায়। অগ্নিসংযোগের পর হিন্দুদের গরু
চুরির সময় এলাকাবাসী রাজীব তালুকদার ও এনামুল হক নামের দুজনকে আটক করে
পুলিশেও দেন।
ব্যাডমিন্টন খেলায় অংশ নেওয়া বিকাশ, পীযূষ, শান্ত
হালদাররা পণ্ডিতবাড়ির বাসিন্দা। তাঁদের এবং তাঁদের স্বজনদের সবার ঘর
পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বাড়ির প্রায় সবাই মোটামুটি শিক্ষিত।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আলো রানী কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রথম আলোকে
বলেন, ‘সিডরে আমার সব গেছে। বহু কষ্ট করে নতুন ঘর তুলছিলাম। কিন্তু হ্যারা
আমার ঘরটা জ্বালাইয়া দিল। আমি হ্যাগো পাও ধইর্যা কইছিলাম, আমারে আগুন
দ্যাও, আমার ঘরে আগুন দিয়ো না। কিন্তু তারা বলে, গ্রামে কোনো হিন্দু ঘর
রাখবে না। সব জ্বালাইয়া দেবে।’
আরতি রানী হালদার আফসোস করে বলেন, ‘তারা আমার ঘরেই কেবল
আগুন দেয় নাই। আমার পালা গরু দুইডারেও পুইড়া মারছে। আমি রশি খুইলা
গরুগুলারে বাঁচাইতে চাইছিলাম। কিন্তু হেইয়া করতে দেয় নাই।’
শ্যামলাল দাস ভয়ার্ত কণ্ঠে বলেন, ‘হাজার হাজার মানুষ
হামলা করছে। আমি আমার কলেজপড়ুয়া মেয়ে আর ছোট ছেলেকে নিয়ে সরে গিয়ে
কোনোমতে জীবন বাঁচিয়েছি। তারা আমার ঘরে আগুন দিয়েছে।’
হিমেল হালদার অভিযোগ করেন, ঘরে আগুন দেওয়ার আগে তারা
লুটপাট করেছে। চম্পা রানী হালদারের অভিযোগ, ঘরে আগুন দেওয়ার আগে তাঁকে
পিটিয়েছে হামলাকারীরা।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, কালীপদ হালদার, ধীরেন
হালদার, বীরেণ হালদার, গোপাল হালদার, হরেকৃষ্ণ হালদার, দীনেশ হালদার, কালু
হালদার, চিত্ত হালদার, রামকৃষ্ণ হালদারসহ পণ্ডিতবাড়ির নয় পরিবারের সব কটি
ঘরই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আছে গোপাল দাস, কৃষ্ণকান্ত দাস,
রাহুল দাস, সুমন দাস ও শ্যামদাসের ঘরও।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ১৫টি ঘর পুরোপুরি পুড়ে গেছে। সাতটি ঘর আংশিক পুড়েছে। সব মিলিয়ে কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু পরিবারগুলো অভিযোগ করেছে, আগুন দেওয়ার
সময় ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে মাত্র চারজন পুলিশ সদস্য ছিলেন। অথচ
রাতে অবস্থা বুঝেই যদি বেশি পুলিশ দেওয়া হতো, তাহলে এ ঘটনা ঘটত না। জেলা
প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তাও একই মন্তব্য করেছেন।
তবে পুলিশের উপকমিশনার এ টি এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেছেন, ‘ঘটনার সময় পুলিশের দায়িত্ব বদল হচ্ছিল। সে কারণেই কম পুলিশ ছিল।’
বরিশাল বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেজাউল ইসলাম
বলেন, শুক্রবার সকালে জহির মারা গেছেন—এ গুজব ছড়িয়ে পড়লে শত শত লোক
সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা চালিয়েছে।
বিভাগীয় কমিশনার মো. নূরুল আমীন, বরিশালের জেলা প্রশাসক
মো. শহীদুল আলম ও মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. শামসুদ্দিনসহ ঊর্ধ্বতন
কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পাশাপাশি ঘটনাস্থলে বিপুলসংখ্যক
পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে।
জেলা ও পুলিশ প্রশাসন দাবি করেছে, পারভেজ গাজীকে কুপিয়ে
হত্যা কিংবা হিন্দুবাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনাকে তাঁরা রাজনৈতিক কোনো
দুরভিসন্ধি কিংবা সাম্প্রদায়িক কোনো ঘটনা বলে মনে করছেন না। বরিশাল মহানগর
পুলিশের কমিশনার শামসুদ্দিন বলেছেন, অগ্নিসংযোগের ঘটনাটি কোনো রাজনৈতিক
ঘটনা নয়। দুই গ্রামের হিন্দু-মুসলিম একত্রেই খেলছিল। খেলা নিয়ে
দ্বন্দ্বের জের ধরেই এসব ঘটেছে। তিনি বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত
রয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চর কাউয়া মাতৃ সরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয়ে পুলিশের একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।
ঘটনা তদন্তে বরিশালের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত
জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) আবুল কালাম আজাদকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি করা
হয়েছে। হত্যা ও বাড়িঘর পোড়ানোর কোনো ঘটনায়ই এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি।
তবে ২৫ জনকে আটক করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে চর
কাউয়া ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়ে সম্প্রীতি বৈঠক হয়েছে।
বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীমা ফেরদৌসী
বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের নগদ ১৯ হাজার টাকা, তিন বান্ডিল টিন, শাড়ি ও
কম্বল দেওয়া হয়েছে।
সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত গতকাল বাদ আসর পারভেজ গাজীর
লাশ তাঁদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। অন্য তিন আহত যুবকের
অবস্থা উন্নতির দিকে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন