নোয়াখালীতে রাজনৈতিক ক্যাডারদের অস্ত্রে হাত পড়েনি পুলিশের এখনো

01জেলা নোয়াখালী  এটি বাইরে থেকে যেমন দেখা যায়, তেমনি উল্টোচিত্রও আছে। খুনোখুনি আর অস্ত্রবাজিতে পিছিয়ে নেই এই শান্তির জেলা। অথচ গত ৫ বছরেও জেলার রাজনৈতিক ক্যাডারদের অস্ত্রে হাত পড়েনি পুলিশের। বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকজন ক্যাডারকে গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধার হলেও বিপুল পরিমান অস্ত্র রয়ে গেছে পুলিশের তালিকাভুক্ত ৪২৬ সন্ত্রাসীর হাতে। যারা কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত। তবে; বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় পুলিশের তালিকা থেকে ছাড় পায় ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা।এদিকে দল ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনায় বেগমগঞ্জের পশ্চিমাঞ্চল, সোনইমুড়ির পশ্চিমাঞ্চল, সেনবাগের দক্ষিণাঞ্চল এবং চাটখিলের পশ্চিমাঞ্চলে বিএনপি-শিবির ক্যাডাররা মাঠে নেমেছে। ইতোমধ্যে বেগমগঞ্জে বিএনপি সমর্থিত দুই সন্ত্রাসীগ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা এবং এক বাহিনী প্রধানে ভাইকে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। সেনবাগের সেবারহাট, বীজবাগ ও ছমিরমুন্সির হাটে গত কয়েকমাসে প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করতেও দেখা গেছে। একই সাথে আওয়ামীলীগ সমর্থিত বিভিন্ন বাহিনী এবং ক্যাডারদেরও প্রকাশ্যে অস্ত্র বহন করতে দেখা গেছে রাজনৈতিক কর্মসূচীকে ঘিরে। এরমধ্যে হাতিয়ায় আওয়ামীলীগ নেতা মো.আলীর সমর্থকদের বিরুদ্ধেও অস্তব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।অপরদিকে আগামি নির্বাচনকে ঘিরে ২৫ অক্টোবরের ১৮ দলীয় জোটের আল্টিমেটাম এবং সম্ভাব্য সহিংসতার আশংকায় এসব অস্ত্র ব্যবহার হতে পারে এমন আশংকা সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা এবং রাজনৈতিক মহলের। বর্তমান সরকারের সময়ে জেলা শহর মাইজদী থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়ে রাজনৈতিক ক্যাডারদেরকে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা গেলেও অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। পুলিশের পরিদর্শক পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তার মতে এখনই অস্ত্র উদ্ধারের সময়। কারণ সরকারের শেষ পর্যায়ে এসে রাজনৈতিক সহিংসতার সুযোগে রাজনৈতিক ক্যাডাররা নিজেদের জাহির করতে চাইবে এবং অস্ত্র প্রদর্শন করবে। যা গত কয়েক মাস থেকে শুরু হয়েছে। তবে; পুলিশ সুপার বলছেন- অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান রয়েছে। প্রয়োজনে বিশেষ অভিযান হবে। তাছাড়া চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের তথ্য দেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নোয়াখালীতে পুলিশের খাতায় তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীর সংখ্যা হচ্ছে ৪২৬জন। যাদের অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, অস্ত্রসহ বিভিন্ন অপরাধে মামলা রয়েছে। এরমধ্যে সুধারামে ৭৩জন, হাতিয়ায় ৪০জন, বেগমগঞ্জে ৯৪জন, সোনাইমুড়িতে ৪৩জন, কোম্পানিগঞ্জে ৩০জন, কবিরহাটে ০৯জন, সেনবাগে ১৯জন, চাটখিলে ৬৯ এবং চরজব্বার থানায় ৪৯জন।পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রাজনৈতিক ক্যাডারদের মধ্যে বেগমগঞ্জের পশ্চিমাঞ্চলে বাশার মেম্বার বাহিনী, সুজন বাহিনী, হারুন বাহিনী, কবির বাহিনী, ছেনী কামাল বাহিনী ও নাসির উদ্দিন ওরফে নাইস্যা বাহিনীর কাছে বিপুল পরিমান অস্ত্র রয়েছে। বেগমগঞ্জের আমান উল্যা পুর, আলাইয়াপুর, গোপালপুর, জীরতলী ও ছয়ানী ইউনিয়নে এসব বাহিনীর নিয়ন্ত্রন রয়েছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে প্রায়শই বাহিনীগুলো খুনোখুনিতে মেতে ওঠে। সর্বশেস ২ সেপ্টেম্বর খুন হয় বিএনপি সমর্থিত কবির বাহিনীর প্রধান কবিরের ভাই কামাল হোসেন। তখন এই খুনের অভিযোগ উঠে বিএনপি সমর্থিত অপর সন্ত্রাসী হারুনের বিরুদ্ধে। গত তিন বছরে এসব এলাকায় একডজনেরও বেশী রাজনৈতিক কর্মী অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হয়েছে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর বেগমগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে বাংলাবাজার এলাকা থেকে অস্ত্রসহ তিন শিবির ক্যাডারকে গ্রেফতার করা হয়।
এছাড়া বেগমগঞ্জের পশ্চিমাঞ্চলের বাংলাবাজার এলাকার ত্রাস ছেনী কামালের বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বাশার মেম্বারের বাহিনীকে বর্তমান সরকারের সময়ে সহযোগীতা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সেনবাগের সেবারহাট, বীজবাগ ইউনিয়ন, ছমিরমুন্সিরহাট এবং নবীপুর-শিবপুর এলাকায় বিএনপি-শিবির ক্যাডারদের অভয়ারণ্য। এছাড়া মিছিল-সমাবেশের সময় সেনবাগ বাজারেও অস্ত্র প্রদর্শন করতে দেখা গেছে সম্প্রতি। পাশাপাশি ছাতারাপাইয়া, কানকিরহাট ও গাজির হাট এলাকায় যেকোন রাজনৈতিক সহিংসতায় উঠে আসে অস্ত্র। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোটের শেষ সময়ে ছাতারাপাইয়া ও কানকিরহাটে জয়নুল আবেদীন ফারুক ও কাজী মফিজ গ্রুপের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষের সময়ও বিপুল পরিমান অস্ত্র প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু গত ৫ বছরেও এসব অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের তৎপরতা চোখে পড়েনি।ইতোপূর্বে সেনবাগে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন একজন পরিদর্শক এ প্রতিনিধিকে জানান, সেনবাগে অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান না হওয়ার পেছনে কারণ হচ্ছে অস্ত্র প্রদর্শন না হওয়া। বিএনপি-জামায়াত ক্যাডারদের হাতে যে অস্ত্র রয়েছে তা মহাজোট ক্ষমতায় আসার পরই তারা সরিয়ে ফেলে। এখন সরকারের শেষ সময় হওয়ায় তারা অস্ত্রগুলো ব্যবহার করবে। ইতোমধ্যে পুলিশের সাথে সেবারহাটে শিবিরে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায়ই সেটি প্রমান করে। তবে; সরকারি দলের প্রশ্রয়ের কারণেও সেনবাগে সন্ত্রাসীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছে।
এছাড়া চাটখিলের সাহাপুর, করটখিল, ইটপুকুরিয়া, রাম নারায়নপুর, বৈকন্ঠপুর, ঘোমাতলি, দেলিয়াইসহ উপজেলার পশ্চিমাঞ্চলে ল²ীপুরের সীমানা এলাকায় সশস্ত্র রাজনৈতিক ক্যাডারদের তৎপরতা বেড়েছে বলে জানা গেছে।
সোনাইমুড়ির সোনাপুর, আমিশাপাড়া ও দেউটি ইউনিয়নে রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের অভয়ারাণ্য। এসব এলাকায় আওয়ামীলীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষ এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধে অন্তত হাফ ডজন রাজনেতিক কর্মী খুন হয়েছে।এদিকে বর্তমানে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেখা গেছে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায়। গত ২৮ সেপ্টেম্বর জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক একামুল করিম চৌধুরীর হাতিয়া আগমন ঠেকাতে মোহাম্মদ আলীর সমর্থকদের সশস্ত্র মহড়ার বিষয়টি দেখেছে দ্বীপবাসী। এর আগের দিন রাতে একসাথে দ্বীপের ৮টি স্থান থেকে ফাঁকা গুলিবর্ষনের ঘটনা ঘটে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন- জেলা শহর মাইজদীতে পুলিশের সাথে জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষের এবং গুলিবিনময়ের সময় এবং কমিটি গঠন নিয়ে ছাত্রদলের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় প্রকাশ্যে অস্ত্র দেখা গেছে জেলা শহরে। এছাড়া ছাত্র শিবিরকে ধাওয়ার সময় একাধিক ছাত্রলীগ কর্মীর হাতে অস্ত্র দেখা গেছে। গতবছর মাইজদী প্রধান সড়কে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সড়ক অবরোধের সময় আলোচিত এক ছাত্রলীগ ক্যাডারের হাতে অস্ত্র দেখা যায়। হালের এক ডিজিটাল ছাত্রলীগ নেতার হাতে অস্ত্র দেখেছে শহরবাসী।শাকিল নামের এক কলেজ ছাত্রকে অপহরণের ঘটনায় গত ৮  এপ্রিল শহীদ ভুলু স্টেডিয়াম এলাকা থেকে পুলিশ একটি  এলজি, একটি পাইপগান, এক রাউন্ড গুলি ও ৬ টি কিরিচ-ছোরা উদ্ধার করেছে। এ ঘটনায় তখন শাকিল নিজে বাদী হয়ে সন্ত্রাসী আজিম, শুভ, সুমন, হোসেন ও বিকু’র নাম উলেøখ করে এবং অজ্ঞাত ৫-৬জন আসামী করে একটি মামলা দায়ের করে।গোয়েন্দা সুত্রগুলো জানায়, কার কাছে অস্ত্র রয়েছে এটি পুলিশ যেমন জানে তেমনি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও অবহিত রয়েছে। তাছাড়া শহরবাসীও তা প্রত্যক্ষ করেছে।এদিকে জেলা শহর থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়ে রাজনৈতিক ক্যাডারদের হাতে এই বিপুল পরিমান অস্ত্র আগামি সময়ে জেলার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করার আশংকা প্রকাশ করেছেন পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারপরও অস্ত্র উদ্ধারে তেমন কোনো অভিযান হয়নি গত ৫ বছরে।
সর্বশেষ দুটি বড় অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা-বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে সেনবাগ উপজেলা ছিলো রীতিমতো অবৈধ অস্ত্রের গুদাম। জয়নুল আবেদীন ফারুক আর প্রতিদ্বন্ধি কাজী মফিজ গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে চলতো অস্ত্রের মহড়া। সেনবাগবাসী এসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেও পুলিশ প্রশাসন ছিলো রীতিমতো দর্শক। তাই জনগণই কখনো কখনো অস্ত্রবাজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে।২০০৭ সালের ৭ জানুয়ারি সেনবাগ উপজেলা বীজবাগ ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামে জয়নুল আবেদীন ফারুকের ২১ ক্যাডারকে অস্ত্রসহ জনতা আটক করে এবং তাদের কাছ থেকে ৪টি একনলা বন্দুক, ১টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল, ১টি এলজি, ৪ রাউন্ড কার্তুজ, ১ রাউন্ড গুলি, ১৬টি তাজা হাতবোমা ও ৩টি রাম দা উদ্ধার করে পুলিশে সোপর্দ করে। একই অবস্থা ছিলে বেগমগঞ্জেও। বেগমগঞ্জের পশ্চিমাঞ্চলে বিএনপির সশস্ত্র ক্যাডারদের দৌরাত্মে সাধারণ জনগণ ছিলো অসহায়। চৌমুহনীতেও একই ভাবে অস্ত্রবাজরা প্রকাশ্যেই অস্ত্রের মহড়া দিতে দেখা যায় তখন। এই অবস্থায় ২০০৬ সালের ২২ নভেম্বর চৌমুহনীতে আবিস্কৃত হয় অস্ত্র কারখানা। সেসময়ে চৌমুহনী পুলিশ ফাঁড়ির হাবিলদার শাজহাজালালের সন্দেহজনক কেঁচো খুড়তে বের হয় অজগর নামের সেই অস্ত্র কারখানা। চৌমুহনীর পুর্ববাজারের এন আমিন ওয়ার্কসপে অস্ত্র তৈরীর সময় ১০টি রিভলবার তৈরীর সম্পূর্ণ সরঞ্জাম উদ্ধার এবং অস্ত্রের অর্ডারদানকারী ছাত্রদল ক্যাডার সোহেলের দূর্গাপুর ইউনিয়নের ল²ীনারায়নপুর গ্রামের বাড়ি থেকে ১টি ১নলা বন্দুক, ৩টি এলজি, ১টি পাইপগান, ১টি রিভলবার ৪ রাউন্ড কার্তুজ, ৫ রাউন্ড বুলেট উদ্ধার করা হয়। তখন গ্রেফতার করা হয়েছিলো ছাত্রদল ক্যাডার সোহেল (২৪), তার ভাই হেদায়েত উল্যা ওরফে মনু (২৬) এবং অস্ত্রের কারিগর সালাহ উদ্দীন। রাজনৈতিক ক্যাডারদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান পিপিএম বলেন- রাজনৈতিক কর্মসূচীর সময় অস্ত্র বহন করছে শিবির ক্যাডারা। এরবাইরেও কারা অস্ত্র বহন করছে কিংবা এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করছে সে তথ্য রয়েছে। বেগমগঞ্জের পশ্চিমাঞ্চলে মূলত ল²ীপুরের সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর প্রশ্রয়ে সন্ত্রাস হচ্ছে। এজন্য চন্দ্রগঞ্জ পশ্চিম বাজারে ল²ীপুরের পুলিশের সাথে যৌথ সভা করা হয়েছে। বেগমগঞ্জের পশ্চিমাঞ্চলের ছেনী কামাল বাহিনীর তিনজনকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে।
অস্ত্র উদ্ধার কিংবা অস্ত্রধারীকে গ্রেফতারের নিয়মিত অভিযান রয়েছে দাবি করে পুলিশ সুপার বলেন- প্রয়োজনে বিশেষ অভিযান হবে। কোনো অস্ত্রধারীর সন্ধান পেলে তাঁর (এসপি) মোবাইল নাম্বারে তথ্য দিতে বলা হয়েছে।

Share on Google Plus

About juwel ishlam

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
    Blogger Comment