ভেদাভেদ ভুলে শান্তিময় অসাম্প্রদায়িক বিশ্ব গড়তে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান


সোমবার হজ্জেআরাফাত দিবসে মক্কার নিকটে মিনয় অবস্থিত নাসিরা মসজিদে হাজ্জীদের একসাথে যোহর ও আসরের সালাত আদায়ের দৃশ্য লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক (হাজির তোমার দরবারে) ধ্বনিতে বিশ্বের প্রায় ২০ লাখ মুসলমান নিজেদেরকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে গতকাল সোমবার পবিত্র হজ্জ পালন করেছেন। ইহ্রামের দু’টুকরো সাদা কাপড় পরিধান করে হাজীরা আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করেছেন। জীবনের সকল অপরাধের কথা স্মরণ করে আল্লাহর রহমত কামনা করেন। তারা বিশ্বের  শান্তি সমৃদ্ধি কামনা করে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন।
গতকাল আরাফার ময়দানে বিশ্বের লাখ লাখ আল্লাহ প্রেমিকের এক মহাসম্মিলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সম্মিলনে চলমান বিশ্বের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে খুতবা প্রদান করেন সৌদি আরবের গ্রান্ড মুফতি শেখ আব্দুল আজিজ বিন আব্দুল্লাহ আলে শায়খ । খুতবায় তিনি সিরিয়াসহ আরববিশ্বের বিভিন্ন দেশের সহিংসতার বর্ণনা তুলে ধরেন। তিনি মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেন, বিভক্তি, বিশৃঙ্খলা এবং সাম্প্রদায়িকতা ত্যাগ করতে হবে। কুরআন হাদীসের মূলনীতির ভিত্তিতে বিশ্বমুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য তিনি আহ্বান জানান। ধর্মের শিক্ষার অনুসরণ ছাড়া কোন শান্তি মিলবে না উল্লেখ করে তিনি পরস্পর ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে শান্তিময় অসাম্প্রদায়িক বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
আজ থেকে ১৪শ ২৪ বছর আগে এই দিনে রাসূল (সাঃ) আরাফার ময়দানে সমবেত লাখো জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণে তিনি ইসলামের পরিপূর্ণতা ঘোষণা করাসহ জীবন পরিচালনার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরেন। আরাফার ময়দানে খুতবার রীতিনীতি অনুযায়ী সৌদী আরবের গ্র্যান্ড ইমাম হাজীদের উদ্দেশ্যে খুতবা প্রদান করেন। এবারের খুতবায় ইসলামের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা তুলে ধরে বিশ্ব মুসলিমের শান্তি, মুক্তি ও কল্যাণ কামনা করা হয়। এছাড়া পবিত্র কুরআন হাদীসের উদ্বৃতি দিয়ে ইসলামের বিভিন্ন বিধি বিধান এবং পরকালের পুরস্কার ও শাস্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।
গ্রান্ড মুফতি শেখ আব্দুল আজিজ বিন আব্দুল্লাহ আলে শায়খ আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অশান্তির বর্ণনা দিয়ে বলেন, আপনাদের জানা উচিত, শত্রু আপনাকে টার্গেট করেছে। আপনাদেরকে দিয়ে বিশৃঙ্খলা ঘটাতে চায়। এখনই সেটা মোকাবিলা করার সময়। এ সময় তিনি সিরিয়া ও অন্যান্য আরব দেশের সংঘাতের বর্ণনা তুলে ধরেন।
তিনি আরো বলেন, সাদা-কালো, ধনী-গরিবের মধ্যে ইসলাম কোন পার্থক্য করেনি। ইসলামে শ্রমিকের অধিকার আদায়ের জন্য জোর দেয়া হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইসলামকে মানুষের আদর্শ হিসেবে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। ইসলামই একমাত্র জীবন ব্যবস্থা বলে আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন। ঐতিহ্যগতভাবে ধর্মীয় সভ্যতাই উৎকৃষ্ট। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।পবিত্র খুতবায় রাসূল (সা.)-এর উত্তম চরিত্রের বিভিন্ন বর্ণনা দেয়া হয়েছে। রাসূলের (সা.) আদর্শ ধারণ করে উত্তম চরিত্রবান হওয়ার জন্য খুতবায় আহ্বান জানানো হয়েছে।আরাফার ময়দান থেকে বিভিন্ন বার্তা সংস্থা জানায়, পবিত্র হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে রোববার ফজরের পর থেকেই মক্কার অদূরে মিনা নগরী অভিমুখে লাখো মানুষের ঢল নামে। বেশিরভাগ লোক গাড়িযোগে, আবার কেউ কেউ ৩/৪ ঘণ্টা পায়ে হেঁটে মিনায় পৌঁছান। শ্বেতশুভ্র লাখো তাঁবুতে ঢাকা পড়েছে মিনা নগরী। চারপাশে মহানবীর ম্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নগরীর জাবালে নূর, জাবালে রহমতসহ বিভিন্ন পাহাড়। এ পাহাড়ের একটির নাম হেরা। এই হেরা গুহায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) নবুয়ত লাভ করেছিলেন। আরাফার ময়দানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মসজিদ ‘মসজিদে নামিরাহ' থেকে হাজীদের উদ্দেশ্যে প্রতি বছরের মত খুতবা দেয়া হয়েছে।খুতবা ও মুনাজাত শেষে সমবেত হাজীরা গতকাল সোমবার যোহর ও আসরের নামায একত্রে আদায় করে সূর্যান্তের পর মুজদালিফার উদ্দেশ্যে আরাফাত ময়দান ত্যাগ করেছেন। হাজিরা বালু ও কংকরময় মুজদালিফায় খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করে মাগরিব ও ইশার নামায আদায় করেন ইশার ওয়াক্তে। এছাড়া পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত, জিকির-আযকার ও ইবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে রাত্রি যাপন করেন। এখান থেকে তারা ৪৯টি ছোট আকারের পাথর সংগ্রহ করে আজ মঙ্গলবার সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই মুজদালিফা থেকে পুনরায় মিনায় ফিরে গিয়ে অদূরে নির্মিত শয়তানের তিনটি প্রতিকৃতির বড় একটি প্রতিকৃতি তথা বড় জামরায় পাথর ছুঁড়ে মারবেন। তারপর কুরবানী করে মাথামু-নের মাধ্যমে পবিত্র হবেন। ইহরামের কাপড় ত্যাগ করে সাধারণ পোশাক পরিধান করে হাজীরা মক্কায় ফিরে গিয়ে পবিত্র কা’বা শরিফ তাওয়াফ করবেন। যারা আজ তাওয়াফ করতে পারবেন না তারা কাল বা পরশু তথা ১৩ জিলহজ্জ পর্যন্ত তাওয়াফ করতে পারবেন।বার্তা সংস্থা জানায়, হাজীদের জন্য সরকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল চোখে পড়ার মতো। আরাফার ময়দানে আকাশে টহল দিচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনীর সাঁজোয়া হেলিকপ্টার। মাঠে রয়েছে পুলিশ, আর্মি, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও স্কাউট সদস্যরা। অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রস্তুত রয়েছে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সংবলিত সিভিল ডিফেন্সের গাড়ি ও হেলিকপ্টার।হাজীদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য মিনা, মুজদালিফা ও আরাফাতে স্থায়ী হাসপাতাল ছাড়া রয়েছে অসংখ্য ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাকেন্দ্র ও এয়ার অ্যাম্বুলেন্স। হাজীদের অসুবিধা দেখার জন্য রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কয়েক হাজার কর্মকর্তা।সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নাইফ জানান, এবার মোট হাজীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৭০ হাজার। এদের মধ্যে  ১৮৮টি দেশ থেকে এসেছ ১২ লাখ ৯০ হাজার। এ সংখ্যা গত বছরের চেয়ে ২১ ভাগ কম। গত বছর হাজীর সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৫০ হাজার।সৌদি সরকারের নেয়া বেশ কয়েকটি নতুন পদক্ষেপের কারণে এবার হাজীদের সংখ্যা কমে গেছে। তবে সবমিলিয়ে ২০ লাখের মতো হাজীর সংখ্যা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।হজ্জ ব্যবস্থাপনার স্বেচ্ছাসেবক মুফরে আল ঘামদি বলেন, ‘এবার ভাইরাস আতঙ্কের কারণে হাজীদের সংখ্যা কম হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে হাজিদের সংখ্যা কমে যাওয়াকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে, হাজীদের মধ্যে একজনও যেন ভাইরাস আক্রান্ত না থাকে।’হাজীদের নিরাপত্তায় এক লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করেছে সৌদি সরকার। নিরাপত্তা বাহিনী ক্যামেরায় পবিত্র শহরগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। আরাফাতের মসজিদ আল নিমিরা থেকে গ্রান্ড মুফতি আবদুল আজিজ আল আশেক হাজীদের উদ্দেশে ভাষণ দেন।সৌদি আরব ভিত্তিক পত্রিকা সৌদি গেজেট নিরাপত্তা অফিসের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, সৌদি আরবের বিভিন্ন পয়েন্টে হজ্জের অনুমতি না থাকায় ৪৬ হাজার ৭১৩ জন দেশী ও বিদেশী হজ্জযাত্রীকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে এবং ১৯ হাজার ১৯৩ জনকে গ্রেফতার করেছে।
Share on Google Plus

About juwel ishlam

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
    Blogger Comment