কিশোরী
মায়েরা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোট
প্রজনন হার কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সার্বিক সাফল্য আছে। কিন্তু কিশোরী
মায়েদের ক্ষেত্রে প্রজনন হার কমছে না। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসংখ্যার
চাপ কমাতে হলে বাল্যবিবাহ কমাতে হবে।জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল
(ইউএনএফপিএ) বলছে, বিশ্বে বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে।
বাংলাদেশ এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারছে না।বাল্যবিবাহ কমাতে একাধিক
মন্ত্রণালয় কাজ করলেও বিক্ষিপ্ত সেই সব কাজ সমস্যার তুলনায় অপ্রতুল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাল্যবিবাহকে জনসংখ্যার সমস্যা হিসেবে দেখে এর বিরুদ্ধে
ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।সর্বশেষ পরিসংখ্যান
অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি ৭০ লাখ। নগররাষ্ট্র বাদ দিলে
বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে এক
হাজার ১৫ জন মানুষ বাস করে। বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩৭
শতাংশ। অনেকে মনে করেন, সম্পদের তুলনায় অধিক জনসংখ্যা বাংলাদেশের
উন্নয়নের পথে বড় বাধা।পরিস্থিতি: বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগে
বাংলাদেশে ৬৪ শতাংশ নারীর বিয়ে হয়। গ্রামে এই হার ৭১ এবং শহরে ৫৪ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও বেসরকারি
প্রতিষ্ঠান প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের জাতীয় জরিপে এ তথ্য পাওয়া
গেছে। ‘চাইল্ড ম্যারেজ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে এ বছর প্রকাশিত ওই জরিপ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষার সঙ্গে বাল্যবিবাহের সম্পর্ক আছে। ১৮ বছরের
কম বয়সে বিয়ে হওয়া নারীদের ৮৬ শতাংশ নিরক্ষর।
দুই দশক ধরে অবস্থা প্রায় একই রকম আছে। জাতীয়
জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) জ্যেষ্ঠ গবেষক সুব্রত
ভদ্র বলেন, ১৯৯৩ সালে দেশে নারীদের বিয়ের গড় বয়স ছিল ১৫ দশমিক ৩ বছর। আর
২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৬ বছরে। তিনি বলেন, ‘দুই দশকে
বিয়ের বয়স বেড়েছে মাত্র এক বছর চার মাস। অর্থাৎ অগ্রগতি সামান্যই।’কিশোরী মায়ের প্রজনন হার কমছে না: ‘চাইল্ড ম্যারেজ
ইন বাংলাদেশ’ গবেষণার সহগবেষক এবং আইসিডিডিআরবির জনসংখ্যা, নগরায়ণ ও
জলবায়ু পরিবর্তন কেন্দ্রের সহযোগী বিজ্ঞানী কামরুন নাহার প্রথম আলোকে
বলেন, আগে বিয়ে মানেই আগে গর্ভধারণ ও শিশুর জন্মদান। তিনি বলেন, গবেষণায়
দেখা গেছে, কিশোরী মায়েরা দ্বিতীয় সন্তানও আগে আগে নেয়। এদের মধ্যে
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার ছেড়ে দেওয়ার হারও বেশি।সুব্রত ভদ্র দুই দশকের তথ্য তুলনা করে দেখেছেন, মোট
শিশু জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে কিশোরী মায়েদের অংশটি বাড়ছে। ১৯৯৩ সালে জন্ম
নেওয়া ৩২ লাখ ৭৮ হাজার শিশুর মধ্যে কিশোরী মায়েরা জন্ম দিয়েছিল ২৬
শতাংশ। ২০১১ সালে জন্ম নেওয়া ৩২ লাখ ৬২ হাজার শিশুর মধ্যে কিশোরী মায়েরা
জন্ম দেয় ২৯ শতাংশ।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ জনসংখ্যার ক্ষেত্রে
সাফল্য অর্জন করেছে মূলত মোট প্রজনন হার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট—টিএফআর)
কমানোর মাধ্যমে। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ বলছে, স্বাধীনতার পরপর
দেশে টিএফআর ছিল ৬ দশমিক ৩। অর্থাৎ একজন মা গড়ে ছয়টির বেশি শিশুর জন্ম
দিতেন। ১৯৯৩ সালে টিএফআর কমে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৪। ২০১১ সালে হয় ২ দশমিক ৩।
সুব্রত ভদ্র বলেন, গত দুই দশকে প্রজননক্ষম নারীদের
মধ্যে টিএফআর কমেছে ৩২ শতাংশ। কিন্তু বয়সভিত্তিক শ্রেণী বিভাজনে দেখা
যায়, ১৫-১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে কমেছে মাত্র ১৬ শতাংশ। আর ২০-২৪ বছর
বয়সীদের মধ্যে ২২ শতাংশ কমেছে। ৩৫-৩৯ বছর বয়সীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি
কমেছে, ৬৩ শতাংশ। ২৫-২৯ বছর ও ৩০-৩৪ বছর বয়স শ্রেণীতে কমেছে যথাক্রমে ৩২ ও
৪৭ শতাংশ।কাজ কী হচ্ছে: বাল্যবিবাহ কমানো বা বন্ধের ব্যাপারে জাতীয়ভিত্তিক প্রচার-প্রচারণা নেই। তবে একাধিক মন্ত্রণালয় এ নিয়ে কাজ করছে।জানতে চাইলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক
(এমআইএস) গণেশ চন্দ্র সরকার বলেন, ২৪২টি উপজেলায় একটি করে স্কুলের নবম ও
দশম শ্রেণীর ছাত্রীদের সচেতন করার কাজ তাঁরা শিগগিরই শুরু করবেন।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব
তারিক-উল-ইসলাম জানান, দেশের ৪০০ উপজেলায় ৪০০ কিশোর-কিশোরী ক্লাব আছে। এ
ছাড়া অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে সারা দেশে আরও তিন হাজার এ রকম
ক্লাব আছে। এসব ক্লাবে বাল্যবিবাহের খারাপ দিক নিয়ে কিশোর-কিশোরীদের সচেতন
করা হয়। এ ছাড়া স্কুল বা কলেজ থেকে ঝরে পড়া প্রায় ১০ হাজার কিশোরীকে
বৃত্তিমূলক কাজের জন্য আর্থিক সহায়তা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, মেয়েদের বিনা
বেতনে শিক্ষা দেওয়ার উদ্যোগ বাল্যবিবাহ কমাতে সহায়তা করছে।বাংলাদেশে কিশোরীর সংখ্যা দেড় কোটির মতো।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পপুলেশন কাউন্সিলের এদেশীয়
পরিচালক ওবায়দুর রব বলেন, সমস্যার তুলনায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ
অপ্রতুল। তিনি বলেন, মেয়েদের কলেজে পড়ার হার বাড়লে বাল্যবিবাহ কমবে।
দেখা গেছে, মেয়েরা শিক্ষিত হলে দেরিতে বিয়ে হয়। এ ছাড়া পরিবার
পরিকল্পনা কর্মসূচির আওতায় জাতীয়ভিত্তিক প্রচার দরকার।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন