অঅ-অ+
বিরোধী
দলের আহূত ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ ঘিরে নিরাপত্তার অজুহাতে সরকারি অবরোধের
মুখে গতকাল সোমবার দ্বিতীয় দিনের মতো প্রায় অচল হয়ে পড়ে যাতায়াতব্যবস্থা।
দিনভর বন্ধ থাকে দূরপাল্লার সড়ক, নৌ ও রেলপথ। কোনো বাস-ট্রেন-লঞ্চ ঢাকা
থেকে যেমন ছাড়েনি, বাইরে থেকেও ঢাকায় প্রবেশ করেনি বিকেল পর্যন্ত। অবশ্য
বিকেল নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর
বিভিন্ন প্রবেশপথ ও ভেতরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে চরম দুর্ভোগের
দৃশ্য। বাসের অভাবে হেঁটে যেতে যেতে অনেকে প্রকাশ্যেই গালাগাল করেছে দেশের
প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে। অনেক স্থানে অসহায়ের মতো
কাঁদতে দেখা গেছে নারী ও শিশুদের। সকাল সাড়ে ৭টায় গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের
সামনে প্রধান সড়কে পুলিশ আটকে দেয় মানিকগঞ্জ থেকে আসা মুদি দোকানি মমিনুল
ইসলামকে। সকাল ৯টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাঁর বড় ভাইয়ের অপারেশন
হবে। কোনো পরিচয়পত্র দেখাতে না পারায় পুলিশ তাঁকে ঢাকায় প্রবেশ করতে
দেয়নি। নিরুপায় মমিনুল পাশে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ‘ভাইয়ের
অবস্থা ভালো না। অপারেশনের সময় কী হয় না হয় বলা যায় না। কিন্তু দেখতে যেতে
পারলাম না। এটা কোন ধরনের রাজনীতির শিকার হলাম আমরা?’
একই
স্থানে আটকা পড়েন ধামরাইয়ের ইউসুফ আলী। একটি চাকরির ব্যাপারে গুলশানের
একটি এনজিও অফিসে একজন কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে রওনা হয়েছিলেন। পুলিশ
তাঁর কাছে পরিচয়পত্র না পেয়ে কিছুক্ষণ আটকে রেখে বাড়ি ফিরে যেতে বলেন।
ইউসুফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়েছিলাম; কিন্তু তাতে কাজ
হয়নি।’ এনজিওর ওই কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারলে চাকরিটা হয়তো হতো
বলেও তিনি আফসোস করেন। সকাল সাড়ে ৮টায় মানিক মিয়া এভিনিউয়ের পশ্চিম
প্রান্তে আড়ংয়ের সামনে দেখা যায় নিত্যদিনের বাহন বাস না পেয়ে কেউ ছুটছে
হলার কিংবা টেম্পো ধরার জন্য, কেউবা হামলে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশার
জন্য। এমনকি চাহিদামতো রিকশা পায়নি অনেকে। মাঝেমধ্যে ডাবল ডেকার বিআরটিসি
বাস আসা-যাওয়া করলেও তা ছিল বাদুড়ঝোলা অবস্থা। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর
নিরুপায় হয়ে সময়মতো অফিস ধরার আশায় অনেকেই ছোটেন হেঁটে।
বনানীতে
একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মী তাসমিয়া রহমান অনেকক্ষণ সিএনজি অটোরিকশার
জন্য অপেক্ষা করে হয়রান হয়ে বলেন, ‘একটি সিএনজি এলেই দেখি পুরুষরা জোরে
দৌড়ে গিয়ে ঠেলাঠেলি করে দখল করে নেয়। আমি তো ভাগে পাই না। রিকশার বেলায়ও
একই অবস্থা। এতটা পথ এখান থেকে হেঁটেও যাওয়া সম্ভব না।’ জাতীয় হৃদরোগ
ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বারান্দায় বসে ভাত খাচ্ছিলেন মাদারীপুরের হালিমা
বেগম। পাশেই মেঝেতে বিছানায় ঘুমাচ্ছিলেন বয়স্ক একজন পুরুষ। হালিমা বলেন,
‘আব্বায় এইহানে ভর্তি আছিল। সুস্থ অইয়া যাওয়ায় কাইল দুপুরে ডাক্তাররা নাম
কাইট্টা দিছে। কিন্তু বাস-গাড়ি বন্ধ থাহায় যাইতে পারি না। ওয়ার্ডেও থাহা
যায় নাই। এই শীতের মইধ্যে এইহানে থাহা ছাড়া কোনো গতি নাই। ঢাকায় রোগী লইয়া
থাহার মতো কোনো বাসাও নাই। আবার হোটেলে থাহার খরচও অইবে না।’ এ সময় ওই
হাসপাতালে বারান্দায় এখানে-সেখানে আরো কয়েকজনকে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়
অবস্থান করতে দেখা যায়। কাছেই ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা.
মঞ্জুর হোসেন বলেন, কয়েকটি শিশুর চিকিৎসা শেষ হয়ে গেছে। তাদের নাম কেটে
দেওয়া হয়েছে নতুন রোগীকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু পরিবহন চালু না
থাকায় তারা বাড়ি ফিরতে পারছে না। এ মানুষগুলো রীতিমতো অসহায় হয়ে পড়েছে।
মহাখালী
ফ্লাইওভারের নিচে ফুটপাতে বসে কাঁদতে দেখা যায় মমতাজ বেগমকে। মায়ের কান্না
দেখে তাঁর সঙ্গে থাকা শিশুকন্যা সামিয়াও কান্না জুড়ে দেয়। মমতাজের স্বামী
আকবর হোসেন বলেন, ‘ঢাকায় মোহাম্মদপুরে থাকি। সকালে খবর পেয়েছি, ভালুকায়
আমার শাশুড়ি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। দ্রুত যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
টেম্পোতে করে কোনোমতে এই পর্যন্ত এসেছি। ভাবছিলাম, এখান থেকে হয়তো
ভালুকাগামী কিছু না কিছু পাওয়া যাবে। দুই ঘণ্টা হয়ে গেল, কিছুই পেলাম না।’
গতকাল
দুপুরে সিলেট যাওয়ার জন্য কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়েও ফিরে আসেন বারিধারার
একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা লতিফুর রহমান। তিনি বলেন, ‘গিয়ে দেখি
আজ নাকি কোনো ট্রেনই চলাচল করেনি। কখন চলবে তাও কেউ বলতে পারছে না।’
বরিশাল থেকে মাওয়া হয়ে রাজধানীর বাবুবাজার ব্রিজের ওপর দিয়ে নগরীতে প্রবেশ
করেন একটি উন্নয়নপ্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা। তিনি আসেন নিজের প্রাইভেট কার
নিয়েই। তবে পথে তাঁকে বহু জায়গায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংগঠনের
নেতা-কর্মীদের জেরার মুখে পড়তে হয়েছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘বরিশাল থেকে
মাওয়ার ওপার পর্যন্ত এসেছি একজনের মোটরসাইকেলে। পরে মাওয়ার এপারে (ঢাকার
দিকে) আগে থেকেই আমার গাড়ি রাখা ছিল দুই দিন ধরে একটি অফিসে। মাওয়া থেকে
ঢাকায় আসতে গিয়ে পথে পথে গাড়ি থামিয়ে আমার পরিচয়পত্র দেখাতে হয়েছে। কোথাও
কোথাও অনেকক্ষণ আটকাও থাকতে হয়েছে। পরে পুলিশের ওপরের পর্যায়ের কারো কারো
সঙ্গে কথা বলে ছাড়া পেয়ে এসেছি।’
এদিকে গতকাল পিএসসির পরীক্ষার
ফল প্রকাশের পর অনেকেই ফল জানতে নিজের স্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভোগান্তির
শিকার হয়। পরিবহনের অভাবে অনেক অভিভাবকই যেতে পারেননি স্কুলে। নাসরিন
নাহার নামের একজন অভিভাবক ফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাসায় ইন্টারনেট
সুবিধা নেই। বাচ্চার পিএসসির ফল জানতে স্কুলে রওনা করেও পথের নানা হয়রানির
ভয়ে আর যাইনি। পরে এক আত্মীয়কে অনুরোধ করেছি ইন্টারনেটে ওর রোল নম্বরটি
দেখে দেওয়ার জন্য।’
এদিকে রাজধানীতে প্রবেশের আরেক পথ
আব্দুল্লাহপুরে আগের দিনের মতোই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা
সক্রিয় ছিলেন। আশপাশের এলাকায় কিছু কিছু গণপরিবহন চলতে দেখা যায়। পুলিশ
পথচারীদের তল্লাশি ও পরিচয়পত্র দেখে ঢাকায় প্রবেশ করতেও দেয়। বিআরটিসির
ডাবল ডেকার বাসও রাজধানীর বিভিন্ন রুটে আসা-যাওয়া করে আব্দুল্লাহপুর থেকে।
আগের
দিনের মতো গতকাল সকাল থেকে যাত্রাবাড়ী মোড়ে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন
থাকতে দেখা যায়। রবিবার এ মোড়ে মঞ্চ বানিয়ে যুবলীগকর্মীরা মার্চ ফর
ডেমোক্রেসির বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। গতকাল সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সে
দৃশ্য দেখা যায়নি।
সায়েদাবাদ দিয়ে দূরপাল্লার কোনো বাস আসতে বা
ছেড়ে যেতে দেখা যায়নি। ঢাকা মহানগরীর মধ্যে চলাচলকারী বাসের সংখ্যাও অন্য
দিনের মতো যাত্রাবাড়ী ও সায়েদাবাদ এলাকায় চোখে পড়েনি। ১৮ দলীয় জোটের
নেতা-কর্মীদের নয়াপল্টনের দিকে যেতে দেখা যায়নি।
গতকাল ভোর
থেকেই সাভার দিয়ে রাজধানীতে প্রবেশের অন্যতম মুখ আমিনবাজারে পর্বত হলের
সামনে যৌথ বাহিনীর সদস্য ঢাকায় প্রবেশকারী যানবাহন এবং যাত্রীদের তল্লাশি
চালান। তবে বিকেল থেকে স্বাভাবিকভাবে রাস্তায় যান চলাচল করতে দেখা গেছে
ব্যাপক হারে।
আনন্দ থেকে বঞ্চিত শিশুরা : প্রাথমিক সমাপনী
(পিএসসি) ও এবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষায় শিশুরা ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করলেও
তাদের এ আনন্দ উদ্যাপনে বাধা হয়ে দাঁড়াল রাজনৈতিক অস্থিরতা। শিশুদের নিয়ে
ঘরের বাইরে বের হওয়ার সাহস পাননি অভিভাবকরা। তাই পরীক্ষার ফল জানতে এসএমএস
ও ইন্টারনেটই ছিল ভরসা। আবার অনেকেই পরীক্ষা শেষে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল।
রাজনৈতিক কর্মসূচি ডিঙিয়ে তারা ঢাকায় ফিরতে পারেনি। গতকাল সোমবার বিভিন্ন
স্কুল ঘুরে দেখা যায়, খুবই কমসংখ্যক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক ফল সংগ্রহ করতে
এসেছেন। অনেক অভিভাবক আতঙ্কে শিশুদের বাসায় রেখে এসেছেন।
মনিপুর
উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঁচটি ক্যাম্পাস থেকে এ বছর দুই হাজার ৮৩৬ শিক্ষার্থী
পরীক্ষা দিলেও ফল সংগ্রহ করতে শ চারেক শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে আসতে দেখা
যায়। হাসিনা পারভীন নামের এক অভিভাবক তাঁর মেয়েকে বাসায় রেখেই এসেছেন
স্কুলে। তিনি বলেন, ‘আমার বাসা আমিনবাজারে। বাস নেই। ভেঙে ভেঙে অনেক কষ্ট
করে একা এসেছি। এই পরিস্থিতিতে বাচ্চাকে আনবই বা কী করে। যদিও এসএমএস করে
ফল জেনেছি, তার পরও রেজাল্ট শিটে নিজের চোখে না দেখে ভালো লাগছিল না। এর
আগে পরীক্ষার সময়ও হরতাল-অবরোধ শিশুকে বিপদে ফেলেছিল।’
মনিপুর
উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘বারবার
হরতাল-অবরোধের কারণে পরীক্ষা নিতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। ফল প্রকাশের
দিনও এ রাজনৈতিক অস্থিরতায় শিশুদের আনন্দে ভাটা পড়েছে। খুব কম শিক্ষার্থীই
ফল নিতে এসেছে।’
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে প্রায়
সাড়ে ৮০০ শিক্ষার্থী অংশ নিলেও ফল নিতে এসেছিল ২০০-এর মতো শিক্ষার্থী।
সামিয়া আক্তার নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘যে অবস্থা শিশুকে নিয়ে বের হব
কিভাবে? তাই একাই এসেছি। গ্রীন রোড থেকে বেইলি রোডে আসতেও খুব ভয়ে ছিলাম।’
তবে যেসব শিশু এসেছিল অভিভাবকরা তাদের নিয়ে খুব দ্রুত বিদ্যালয় ত্যাগ
করেছেন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন