অঅ-অ+
নির্বাচন
নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং নির্বাচন হলেও কারা এতে অংশ নেবে আর কারা নেবে না, সে
জটিলতার মধ্যেই ভেতরে ভেতরে চলছে নির্বাচনকালীন সরকারের সদস্য ও নির্বাচনী
আসন ভাগাভাগি নিয়ে দরকষাকষি। এমনকি জোটগত অদলবদলের প্রক্রিয়া বা নির্বাচনে
অংশ নেওয়া-না নেওয়ার হুমকি-ধমকির নেপথ্যেও আছে এই আসন ভাগাভাগির বিষয়টি।
এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে অংশ নেবে
কি না তা নিয়ে নানামুখী আলোচনা রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, জাতীয়
পার্টি সর্বদলীয় সরকারে অংশ নেবে- এটা নিশ্চিত। দলটি এখন দরকষাকষি করছে
তাদের বেশিসংখ্যক সদস্যকে সরকারে অন্তর্ভুক্তির দাবি নিয়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় পার্টি সর্বদলীয় সরকারে কমপক্ষে পাঁচজন সদস্য দাবি করেছে। এ ছাড়া নির্বাচনে ১০০ আসনও চায় দলটি। তবে আওয়ামী লীগ সর্বদলীয় সরকারে তাদের তিনজনের বেশি রাখতে চায় না। এ বিষয়টি সুরাহা হলেই এরশাদ সর্বদলীয় সরকারে যোগদানের প্রকাশ্য ঘোষণা দেবেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ভেতরে ও বাইরে থাকা সরকারবিরোধী কয়েকটি দলও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন নিয়ে দরকষাকষিতে জড়িয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট দলগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর সদস্যদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই, এমন দলগুলো থেকে সরকারে অন্তর্ভুক্তির জন্য বিভিন্ন দলের প্রস্তাব থাকলেও তা আমলে নেওয়া হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, ২৫ নভেম্বরের মধ্যে সর্বদলীয় সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে। ওই নেতারা নিশ্চিত করেন, সম্ভাব্য এ তারিখ ধরেই সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচন বর্জন করার দল নয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনেও তারা অংশ নিয়েছে, এবারও নেবে। তিনি বলেন, সর্বদলীয় সরকারে এরশাদের দল আসবে। কারণ তাদের ভালো-মন্দ নিয়ে তারা ওয়াকিবহাল। সর্বদলীয় সরকার গঠনের দিনক্ষণ চূড়ান্তভাবে জানাতে না পারলেও তিনি বলেন, শিগগিরই হতে পারে।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য জানান, সর্বদলীয় সরকারে পাঁচজন সদস্য দাবি করছে জাতীয় পার্টি। তবে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে এত সদস্য দিতে রাজি নয়।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পবিত্র ওমরাহ পালন করতে শিগগিরই সৌদি আরবে যাচ্ছেন। সেখান থেকে ফিরে এলেই সর্বদলীয় সরকার গঠন করা হবে। সূত্র আরো জানায়, কারা থাকছেন এ সরকারে এটাও প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচনকালীন এই সর্বদলীয় সরকারে থাকবেন শুধু সংসদ সদস্যরাই।
সরকারের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ১৮ দলীয় জোট আলোচনায় আসবে না, এটা ধরেই নিয়েছে আওয়ামী লীগ। তাই তাদের বাদ দিয়েই সর্বদলীয় সরকার গঠনের কাজ চলছে।
জানা গেছে, মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের শরিক দলগুলো থেকে বেশি সদস্য নেওয়ার দাবি উঠলে সরকারের আকার বড় হতে পারে। শেষ পর্যন্ত সমঝোতা হলে বিএনপির কমপক্ষে পাঁচজন সংসদ সদস্যকে সর্বদলীয় সরকারের অংশ করতে পারেন শেখ হাসিনা। এ ছাড়া সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিকে (এলডিপি) এ সরকারে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি সূত্র। পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গত বুধবার রাতে এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদের সঙ্গে তাঁর বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎ করে তাঁকে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। অলি আহমদ এ বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত জানাতে কয়েক দিন সময় চেয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, সর্বদলীয় সরকার গঠন প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। যেকোনো সময় গঠন হয়ে যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাদের নিয়ে এ সরকার দাঁড় করাবেন তাও চূড়ান্ত করে রেখেছেন।
সূত্র মতে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সর্বদলীয় সরকারের সদস্য হিসেবে যাঁদের নাম প্রায় চূড়ান্ত তাঁদের মধ্যে আছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আবুল মাল আবদুল মুহিত, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, ওবায়দুল কাদের, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জি এম কাদের, আওয়ামী লীগ নেতা ড. আবদুর রাজ্জাক ও ডা. দীপু মনি। টেকনোক্র্যাট কোটায় থাকতে পারেন ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দেন। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকেও নাম চান, যাঁদের অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য করা হবে। কিন্তু বিএনপি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে মতপার্থক্য রেখেই সর্বদলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
সূত্র মতে, বরাবরের মতো এবারও নির্বাচনী আসন নিয়ে দরকষাকষির ক্ষেত্রে সবার বিশেষ নজর রয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির দিকে। আলোচনা আছে আসন বিবেচনায়ও পাল্টে যেতে পারে এরশাদের অবস্থান। আসনের দরকষাকষিতে বনিবনা হলেই নির্বাচনকেন্দ্রিক বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটা বদলে যেতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপি নির্বাচনে না এলে ১৪ দলসহ নির্বাচনমুখী অন্যান্য দলের আসন ভাগাভাগির অঙ্ক হবে এক ধরনের। আর বিএনপি নির্বাচনে এলে ওই হিসাব পাল্টে যাবে। তাই সব দলেই এখন পর্যন্ত দুই ধরনের চিন্তাভাবনা নিয়ে প্রস্তুতি চলছে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার কথা ঘোষণা করলেও তাঁর এই ঘোষণা নিয়ে দলের মধ্যেই অনেকের সংশয় রয়েছে। জাতীয় পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের পার্টির চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তবে তিনি কখন কী সিদ্ধান্ত নেন আর পরিবর্তন করেন, তা আমরা অনেক সময় আগেভাগে জানতে পারি না। তাই এ নির্বাচনেও শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি।'
ওই নেতা বলেন, 'নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবশ্যই আসনের প্রশ্ন থাকবে। আমাদের প্রত্যাশা আগের চেয়ে অনেক বেশি আসনে আমরা এবার জয়ী হতে পারব। মানুষ আওয়ামী লীগ-বিএনপির ওপর অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তাই আমাদের ভোট বেড়েছে, সে হিসাবে আসনও স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। এ ক্ষেত্রে আমরা যদি একক নির্বাচন না করি তবে যে জোটেই যাব সেখানে আমাদের কতটি আসন দেওয়া হবে সে নিয়ে দরকষাকষি হতেই পারে। সে জন্য আমাদের পার্টির ভেতরে এক ধরনের প্রস্তুতি তো আগে থেকেই চলে আসছে। কিন্তু সংখ্যাটি এখনো নির্ধারণ হয়নি।'
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলভুক্ত বিভিন্ন দলের আসন চাহিদা এবার তিন-চার গুণ বেশি। এই দলগুলোর মধ্যে আছে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদ, রাশেদ খান মেনন এমপির নেতৃত্বাধীন ওয়ার্কার্স পার্টি, শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দলসহ আরো কয়েকটি দল। এর বাইরে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির (জেপি) আসনের বিষয়টিও এখন আলোচনায় উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আসনের বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে। আমাদের সভাপতিরও নজরে আছে। কারণ আমরা ইতিমধ্যেই মাঠ পর্যায়ের জরিপের মাধ্যমে সব আসনের চিত্র পেয়েছি। কোন আসনে কোন প্রার্থীর অবস্থান কেমন সেই তথ্য আমাদের কাছে আছে। কেবল আমাদের দলই নয়, ১৪ দলের শরিক অন্যান্য দলের সম্ভাব্য প্রার্থী, এমনকি বিরোধীদলীয় জোটের প্রার্থীদের ব্যাপারেও আমরা খোঁজখবর নিয়ে রেখেছি।'
মাহবুল-উল-আলম হানিফ বলেন, 'আসন বণ্টনের বিষয়টি ফয়সালা হবে তফসিল ঘোষণার পর। ১৪ দলভুক্ত সবার সঙ্গে আলোচনা করেই এটা করা হবে।' তিনি বলেন, অন্যদের প্রত্যাশা থাকতেই পারে। কিন্তু বাস্তবতা সবাইকেই মেনে নিতে হবে।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নির্বাচনী প্রস্তুতির পাশাপাশি আমরা দলের ভেতরে আমাদের সম্ভাব্য আসন নিয়েও আলোচনা ও প্রস্তুতি নিয়েছি। আমরা মনে করছি, আমাদের অবস্থান আগের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে। সেদিক বিবেচনায় আমরা ইতিমধ্যেই প্রাথমিকভাবে ৪০টি আসন চিহ্নিত করেছি, যা নিয়ে আমরা ১৪ দলের সঙ্গে সময়মতো আলোচনায় বসব।' তিনি আরো বলেন, '৪০টি আসন চিহ্নিত করা হলেও আমরা একটি শর্ট লিস্টও করে রেখেছি।'
জাসদের সাধারণ সম্পাদক শরীফ নুরুল আম্বিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আসনের ব্যাপারে আমরা ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিচ্ছি। গত বছর আমরা চারটি আসন পেয়েছিলাম, জয়ী হয়েছি তিনটিতে। অবশ্যই গত বছরের তুলনায় কয়েকটি আসনে আমাদের অবস্থান এবার অনেক ভালো হয়েছে। সে অনুসারে আমরা তিন-চারগুণ বেশি আসন আশা করব। তবে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি।' ওই নেতা বলেন, 'আওয়ামী লীগের এবং আমাদের দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহে সময় শেষ হবে ১৭ নভেম্বর একই দিনে। তাই ওই সময় পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করে তারপর আসনের আলোচনায় যাব।'
সাম্যবাদী দলের সভাপতি ও শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা ২৫টি আসনের জন্য একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করেছি। তবে এই তালিকা আরো ছোট হতে পারে।' তিনি বলেন, এখনো ১৪ দলের ভেতর আনুষ্ঠানিকভাবে এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে সবাই নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর এ ইস্যুটি নিয়ে সিদ্ধান্তে যাওয়ার প্রয়োজন হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় পার্টি সর্বদলীয় সরকারে কমপক্ষে পাঁচজন সদস্য দাবি করেছে। এ ছাড়া নির্বাচনে ১০০ আসনও চায় দলটি। তবে আওয়ামী লীগ সর্বদলীয় সরকারে তাদের তিনজনের বেশি রাখতে চায় না। এ বিষয়টি সুরাহা হলেই এরশাদ সর্বদলীয় সরকারে যোগদানের প্রকাশ্য ঘোষণা দেবেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ভেতরে ও বাইরে থাকা সরকারবিরোধী কয়েকটি দলও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন নিয়ে দরকষাকষিতে জড়িয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট দলগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর সদস্যদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই, এমন দলগুলো থেকে সরকারে অন্তর্ভুক্তির জন্য বিভিন্ন দলের প্রস্তাব থাকলেও তা আমলে নেওয়া হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, ২৫ নভেম্বরের মধ্যে সর্বদলীয় সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে। ওই নেতারা নিশ্চিত করেন, সম্ভাব্য এ তারিখ ধরেই সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচন বর্জন করার দল নয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনেও তারা অংশ নিয়েছে, এবারও নেবে। তিনি বলেন, সর্বদলীয় সরকারে এরশাদের দল আসবে। কারণ তাদের ভালো-মন্দ নিয়ে তারা ওয়াকিবহাল। সর্বদলীয় সরকার গঠনের দিনক্ষণ চূড়ান্তভাবে জানাতে না পারলেও তিনি বলেন, শিগগিরই হতে পারে।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য জানান, সর্বদলীয় সরকারে পাঁচজন সদস্য দাবি করছে জাতীয় পার্টি। তবে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে এত সদস্য দিতে রাজি নয়।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পবিত্র ওমরাহ পালন করতে শিগগিরই সৌদি আরবে যাচ্ছেন। সেখান থেকে ফিরে এলেই সর্বদলীয় সরকার গঠন করা হবে। সূত্র আরো জানায়, কারা থাকছেন এ সরকারে এটাও প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচনকালীন এই সর্বদলীয় সরকারে থাকবেন শুধু সংসদ সদস্যরাই।
সরকারের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ১৮ দলীয় জোট আলোচনায় আসবে না, এটা ধরেই নিয়েছে আওয়ামী লীগ। তাই তাদের বাদ দিয়েই সর্বদলীয় সরকার গঠনের কাজ চলছে।
জানা গেছে, মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের শরিক দলগুলো থেকে বেশি সদস্য নেওয়ার দাবি উঠলে সরকারের আকার বড় হতে পারে। শেষ পর্যন্ত সমঝোতা হলে বিএনপির কমপক্ষে পাঁচজন সংসদ সদস্যকে সর্বদলীয় সরকারের অংশ করতে পারেন শেখ হাসিনা। এ ছাড়া সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিকে (এলডিপি) এ সরকারে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি সূত্র। পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গত বুধবার রাতে এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদের সঙ্গে তাঁর বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎ করে তাঁকে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। অলি আহমদ এ বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত জানাতে কয়েক দিন সময় চেয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, সর্বদলীয় সরকার গঠন প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। যেকোনো সময় গঠন হয়ে যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাদের নিয়ে এ সরকার দাঁড় করাবেন তাও চূড়ান্ত করে রেখেছেন।
সূত্র মতে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সর্বদলীয় সরকারের সদস্য হিসেবে যাঁদের নাম প্রায় চূড়ান্ত তাঁদের মধ্যে আছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আবুল মাল আবদুল মুহিত, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, ওবায়দুল কাদের, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জি এম কাদের, আওয়ামী লীগ নেতা ড. আবদুর রাজ্জাক ও ডা. দীপু মনি। টেকনোক্র্যাট কোটায় থাকতে পারেন ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দেন। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকেও নাম চান, যাঁদের অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য করা হবে। কিন্তু বিএনপি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে মতপার্থক্য রেখেই সর্বদলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
সূত্র মতে, বরাবরের মতো এবারও নির্বাচনী আসন নিয়ে দরকষাকষির ক্ষেত্রে সবার বিশেষ নজর রয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির দিকে। আলোচনা আছে আসন বিবেচনায়ও পাল্টে যেতে পারে এরশাদের অবস্থান। আসনের দরকষাকষিতে বনিবনা হলেই নির্বাচনকেন্দ্রিক বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটা বদলে যেতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপি নির্বাচনে না এলে ১৪ দলসহ নির্বাচনমুখী অন্যান্য দলের আসন ভাগাভাগির অঙ্ক হবে এক ধরনের। আর বিএনপি নির্বাচনে এলে ওই হিসাব পাল্টে যাবে। তাই সব দলেই এখন পর্যন্ত দুই ধরনের চিন্তাভাবনা নিয়ে প্রস্তুতি চলছে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার কথা ঘোষণা করলেও তাঁর এই ঘোষণা নিয়ে দলের মধ্যেই অনেকের সংশয় রয়েছে। জাতীয় পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের পার্টির চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তবে তিনি কখন কী সিদ্ধান্ত নেন আর পরিবর্তন করেন, তা আমরা অনেক সময় আগেভাগে জানতে পারি না। তাই এ নির্বাচনেও শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি।'
ওই নেতা বলেন, 'নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবশ্যই আসনের প্রশ্ন থাকবে। আমাদের প্রত্যাশা আগের চেয়ে অনেক বেশি আসনে আমরা এবার জয়ী হতে পারব। মানুষ আওয়ামী লীগ-বিএনপির ওপর অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তাই আমাদের ভোট বেড়েছে, সে হিসাবে আসনও স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। এ ক্ষেত্রে আমরা যদি একক নির্বাচন না করি তবে যে জোটেই যাব সেখানে আমাদের কতটি আসন দেওয়া হবে সে নিয়ে দরকষাকষি হতেই পারে। সে জন্য আমাদের পার্টির ভেতরে এক ধরনের প্রস্তুতি তো আগে থেকেই চলে আসছে। কিন্তু সংখ্যাটি এখনো নির্ধারণ হয়নি।'
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলভুক্ত বিভিন্ন দলের আসন চাহিদা এবার তিন-চার গুণ বেশি। এই দলগুলোর মধ্যে আছে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদ, রাশেদ খান মেনন এমপির নেতৃত্বাধীন ওয়ার্কার্স পার্টি, শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দলসহ আরো কয়েকটি দল। এর বাইরে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির (জেপি) আসনের বিষয়টিও এখন আলোচনায় উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আসনের বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে। আমাদের সভাপতিরও নজরে আছে। কারণ আমরা ইতিমধ্যেই মাঠ পর্যায়ের জরিপের মাধ্যমে সব আসনের চিত্র পেয়েছি। কোন আসনে কোন প্রার্থীর অবস্থান কেমন সেই তথ্য আমাদের কাছে আছে। কেবল আমাদের দলই নয়, ১৪ দলের শরিক অন্যান্য দলের সম্ভাব্য প্রার্থী, এমনকি বিরোধীদলীয় জোটের প্রার্থীদের ব্যাপারেও আমরা খোঁজখবর নিয়ে রেখেছি।'
মাহবুল-উল-আলম হানিফ বলেন, 'আসন বণ্টনের বিষয়টি ফয়সালা হবে তফসিল ঘোষণার পর। ১৪ দলভুক্ত সবার সঙ্গে আলোচনা করেই এটা করা হবে।' তিনি বলেন, অন্যদের প্রত্যাশা থাকতেই পারে। কিন্তু বাস্তবতা সবাইকেই মেনে নিতে হবে।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নির্বাচনী প্রস্তুতির পাশাপাশি আমরা দলের ভেতরে আমাদের সম্ভাব্য আসন নিয়েও আলোচনা ও প্রস্তুতি নিয়েছি। আমরা মনে করছি, আমাদের অবস্থান আগের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে। সেদিক বিবেচনায় আমরা ইতিমধ্যেই প্রাথমিকভাবে ৪০টি আসন চিহ্নিত করেছি, যা নিয়ে আমরা ১৪ দলের সঙ্গে সময়মতো আলোচনায় বসব।' তিনি আরো বলেন, '৪০টি আসন চিহ্নিত করা হলেও আমরা একটি শর্ট লিস্টও করে রেখেছি।'
জাসদের সাধারণ সম্পাদক শরীফ নুরুল আম্বিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আসনের ব্যাপারে আমরা ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিচ্ছি। গত বছর আমরা চারটি আসন পেয়েছিলাম, জয়ী হয়েছি তিনটিতে। অবশ্যই গত বছরের তুলনায় কয়েকটি আসনে আমাদের অবস্থান এবার অনেক ভালো হয়েছে। সে অনুসারে আমরা তিন-চারগুণ বেশি আসন আশা করব। তবে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি।' ওই নেতা বলেন, 'আওয়ামী লীগের এবং আমাদের দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহে সময় শেষ হবে ১৭ নভেম্বর একই দিনে। তাই ওই সময় পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করে তারপর আসনের আলোচনায় যাব।'
সাম্যবাদী দলের সভাপতি ও শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা ২৫টি আসনের জন্য একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করেছি। তবে এই তালিকা আরো ছোট হতে পারে।' তিনি বলেন, এখনো ১৪ দলের ভেতর আনুষ্ঠানিকভাবে এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে সবাই নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর এ ইস্যুটি নিয়ে সিদ্ধান্তে যাওয়ার প্রয়োজন হবে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন