জীবনের চেয়েও বাণিজ্য বড়
-জীবনের চেয়েও বাণিজ্য বড়
আল-কায়েদা নেতা আয়মান আল জাওয়াহিরির অডিওবার্তা প্রচারিত হওয়ার পর দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থা। জঙ্গিদের ওপর বিশেষ নজর রাখার নির্দেশও দেওয়া হয় সরকারের তরফ থেকে। নিরাপত্তা জোরদারের যখন এত আয়োজনের নির্দেশ ঠিক তখনই দেশি জঙ্গিরা পুলিশকে খুন করে ছিনিয়ে নিয়ে যায় তিন জঙ্গিকে। এ ঘটনাকে ‘ভয়ংকর’ অভিহিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় কথা উঠেছে, গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহে নেওয়ার সময় তিন জঙ্গি পুলিশের দেওয়া মোবাইল ফোনসেট দিয়ে কথা বলছিল নানাজনের সঙ্গে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু এ ঘটনাই নয়, আদালতে নেওয়ার সময় বা প্রিজন ভ্যানে করে বন্দিদের স্থানান্তর করার সময় পুলিশ মোবাইল ফোন ভাড়ায় খাটায়। এতে কখনো কখনো এক মিনিটের জন্য হাজার টাকাও ভাড়া পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, আদালতে বা প্রিজন ভ্যানে থাকা অবস্থায় পুলিশ প্রতি মিনিটে সর্বন্মিন ৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকায় কথা বলার ব্যবস্থা করে দেয়।ডিসি প্রসিকিউশন মো. আনিসুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোনো বন্দিকে মোবাইল ফোনে কথা বলার সুযোগ দেওয়া অপরাধ। যদি কোনো পুলিশ সদস্য এ অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।’ ঢাকা জজ কোর্টের এক আইনজীবী কালের কণ্ঠকে জানান, ‘অনেক সময় দেখা যায়, নিরাপত্তার চেয়ে বাণিজ্যের দিকেই নজর বেশি থাকে পুলিশের। কাঁচা পয়সার চিন্তায় নিজের নিরাপত্তার কথাও ভাবে না তারা।’মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ত্রিশালের ঘটনা দেখে বোঝা গেছে, পুলিশ এসকর্টে বন্দি স্থানান্তরের সময় পুলিশের দূরদর্শিতা ও দক্ষতার অভাব রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ত্রিশালের ঘটনাটি খুবই ভয়ংকর। গা শিউরে ওঠার মতো। যেখানে জঙ্গিদের টার্গেট পুলিশ, সেখানে দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের এক জেলা থেকে আরেক জেলায় নিয়ে যাওয়ার সময় নিরাপত্তায় এত হেলাফেলা দেখে অবাক হতে হয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে এ ঘটনাটাকে মাথায় রেখে জঙ্গিদের স্থানান্তরের ক্ষেত্রে পুলিশের নিরাপত্তাব্যবস্থা সাজাতে হবে।’ছিনিয়ে নেওয়া তিন জঙ্গির একজন সালাউদ্দিন সালেহীন ছিল কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-১-এ। পার্ট-২-এ বন্দি ছিল জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজান। আর কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে ছিল রাকিবুল হাসান। কারা সূত্র জানায়, তিনজন বন্দি তিনটি কারাগারে থাকার কারণে তিনটি কারাগার থেকেই গাজীপুরের পুলিশ সুপারের কাছে এসকর্ট চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়। সে অনুযায়ী গাজীপুর জেলা পুলিশ দায়িত্ব পালন করে।কাশিমপুর-১ কারাগারের সিনিয়র সুপার জামিল আহমেদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে জানান, ‘স্থানান্তরের জন্য আমরা কোনো আসামিকে কারাগার থেকে বের করে পুলিশের কাছে বুঝিয়ে দিই। পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার পর কারাগারের আর কোনো দায়দায়িত্ব থাকে না।’গাজীপুর পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কারাগার থেকে আমাদের কাছে চিঠি লিখেছিল। সে অনুযায়ী পুলিশ এসকর্টও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এমন ঘটনা ঘটবে, সেটা কেউ আগে বুঝতে পারেনি।’গাজীপুর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, তিন জঙ্গির সঙ্গে বাইরের জঙ্গিদের আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। নতুন কেনা দুটি সিমের মাধ্যমে ওই যোগাযোগ হয়। রবিবার সকালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে ফিল্মি কায়দায় পুলিশ হত্যা করে প্রিজন ভ্যান থেকে জেএমবির দুর্ধর্ষ তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় পুলিশের তদন্তে এমন আভাস মিলেছে। এ ছাড়া ছিনতাই কাজে জঙ্গি জাকারিয়ার ব্যবহৃত মাইক্রোবাস থেকে অস্ত্র ও অন্যান্য আলামতের সঙ্গে তিনটি মোবাইল ফোনসেটও জব্দ করে সখীপুর থানাপুলিশ। ওই তিন মোবাইলের মালিক কে, সর্বশেষ কার সঙ্গে কথা হয়েছে- এসবও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।রবিবার ঘটনার পর কাশিমপুর কারাগারের সামনের এলাকার একাধিক ব্যবসায়ী নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, অনেক ক্ষেত্রে পুরনো বন্দিদের কারাগার থেকে আদালতে নেওয়ার সময় প্রিজন ভ্যানে মোবাইলে কথা বলতে দেখা যায়। পুলিশ সদস্যরাই টাকার বিনিময়ে মোবাইল দিয়ে দেন। কখনো কখনো বন্দিদের আত্মীয়রাও মোবাইল দেয়। তারা যাওয়া-আসার পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে কথা বলে। এসব ওপেন সিক্রেট। রবিবার ওই তিন জঙ্গিকে ময়মনসিংহ আদালতে নেওয়ার সময় পথে কথা বলার সুযোগ দিয়ে থাকতে পারে পুলিশ।ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত মাইক্রোবাসের চালক জঙ্গি কাওসার ধরা পরার পর স্বীকার করেছে, সে কয়েকজন সহযোগীর সঙ্গে শনিবার ভালুকায় রাত যাপন শেষে রবিবার অপারেশনে অংশ নেয়। সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে তাদের লোক ছিল। তারা প্রিজনভ্যানের গতিবিধি নজরে রাখছিল।সখীপুর থানার এসআই ওমর ফারুক জানান, জঙ্গি জাকারিয়ার মাইক্রোবাস থেকে তিনটি মোবাইল উদ্ধারের পর জব্দ করা হয়েছে। মোবাইলগুলো কার, কারা কথা বলেছে- সবই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।এদিকে তিন জঙ্গিকে বহনকারী প্রিজন ভ্যানের দায়িত্বে থাকা এক এসআই ও তিন পুলিশের বিরুদ্ধে জঙ্গিদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আহত এসআই হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমার অবসরের অল্প কিছুদিন বাকি আছে। জঙ্গিদের মোবাইল দেওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। এসবই অসত্য।’ নিহত কনস্টেবল আতিকুল ইসলামের শ্যালক সোহাগ জানান, আতিকুলের দুটি মোবাইল ছিল। একটি পাওয়া গেছে। অন্যটি মেসে না কোথায় আছে তা জানেন না। কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের সুপার আবদুর রাজ্জাক জানান, কারাগার এলাকায় নেটওয়ার্কে জ্যাম করা আছে। বন্দিদের মোবাইল ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই।ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক জানান, পুলিশ জঙ্গিদের মোবাইল ফোন দিয়েছিল কি না তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন