
পিলখানার দরবার হলে বিদ্রোহ শুরু হতেই ভেতরে থাকা বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) হাসপাতালের কজন ডাক্তার বেরিয়ে যেতে থাকেন। দরবার হলের বাইরে পা দিতেই সিপাহি সেলিম রেজা ও তাঁর সঙ্গীরা তাঁদের মাটিতে ফেলে বুট দিয়ে লাথি মারতে থাকেন। এরপর মহিলা ডাক্তারদের পিকআপ ভ্যানে উঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই পিকআপে ডাক্তার লেফটেন্যান্ট কর্নেল লুৎফর রহমান খানও ওঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিদ্রোহীরা তাঁকে চেপে ধরে রাখেন। চলে যায় পিকআপটি। এরপর রাইফেল তাক করে একের পর এক গুলি করে হত্যা করা হয় এই চিকিৎসক কর্নেলকে। তাঁর রক্ত দেখে উল্লাস প্রকাশ করেন বিদ্রোহীরা।বিদ্রোহের এমন লোমহর্ষক চিত্র উঠে আসে মামলার তদন্তে। সেদিন লুৎফর রহমান উঠতে না পারলেও ওই পিকআপে ডাক্তার লে. কর্নেল কাজী রবি রহমান উঠতে পেরেছিলেন। কিন্তু কিছু দূর নিয়েই গাড়ি থামিয়ে তাঁকে নামানো হয়। তিনি চিৎকার করে বারবার তাঁর চিকিৎসক পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যাঁদের চিকিৎসা দিয়েছিলেন এত দিন, সেই বিডিআর জওয়ানরা তাঁর পরিচয়ের জবাব দেন গুলি করে হত্যা করে। সেদিন এমন নৃশংসভাবে আরো ৫৫ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। আজ বিডিআর বিদ্রোহের পাঁচ বছর পূর্ণ হলো। এরই মধ্যে পিলখানা হত্যা মামলার রায় হয়েছে। গত ৫ নভেম্বর ঢাকা মহানগর তৃতীয় অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের দেওয়া রায়ে ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে চারজনকে ৪৪ বছরের (যাবজ্জীবন ও ১৪ বছর) কারাদণ্ড, ১৫৭ জনকে ৪০ বছরের (যাবজ্জীবন ও ১০ বছর) কারাদণ্ডসহ জরিমানা করা হয়। যাবজ্জীবন সাজার সঙ্গে অস্ত্র লুট ও অন্যান্য অপরাধের জন্যও তাঁদের সাজা দেওয়া হয়। প্রতিটি সাজা একটির পর একটি চলবে বলে রায়ে বলা হয়। ২৭৭ জন বেকসুর খালাস পান।সেদিন যা ঘটেছিল : বিডিআর সপ্তাহ পালনের উৎসব ছিল ওই দিন। বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছিল পিলখানাকে। কিন্তু কে জানত ওই দিনই জন্ম হবে ইতিহাসের এক ঘৃণ্যতম অধ্যায়ের। দেশের মেধাবী সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে প্রাণ দিতে হবে।পিলখানা হত্যা মামলার তদন্ত থেকে জানা যায়, ২৫ ফেব্রুয়ারি দরবার হলে মহাপরিচালকের (ডিজি) দরবারে মোট ৯৭ জন কর্মকর্তা ও দুই হাজার ৪৮৩ জন জওয়ান ও অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে দরবার শুরু হওয়ার পর ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল আহম্মেদ তাঁর বক্তব্য দিতে থাকেন। তাঁর বক্তব্যের প্রায় শেষ পর্যায়ে হঠাৎ একটা শব্দ হয়। দরবার হলের পূর্ব-দক্ষিণে রান্নাঘরের দিক থেকে সিপাহি মাঈন, ১৩ রাইফেলস ব্যাটালিয়ন অস্ত্র নিয়ে দরবার হলের মঞ্চে ঢোকেন। পেছনে পেছনে ৪৪ রাইফেলস ব্যাটালিয়ন সিপাহি কাজল আলী একটি রাইফেল হাতে মঞ্চের দিকে আসেন। সিপাহি মাঈন ডিজির দিকে অস্ত্র তাক করে ধরেন। সঙ্গে সঙ্গে আশপাশে থাকা সেনা কর্মকর্তারা তাকে আটক করে ফেলেন। দরবার হলে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। ওই সময় সিপাহি কাজল দরবার হল থেকে বের হয়ে এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করেন। মুহূর্তের মধ্যে বিডিআর সিপাহিদের দুটি গ্রুপ দরবার দল ঘিরে ফেলে গুলি করে এবং গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটায়। কর্মকর্তারা জীবন রক্ষার জন্য দরবার হলের মঞ্চের পেছনে, টয়লেট ও বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের আড়াল করে রাখার চেষ্টা করেন। অনেক কর্মকর্তা দরবার হল থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। মেজর শাহ নেওয়াজ, মেজর খালিদ হোসেন ও মেজর ইদ্রিস দরবার হলের দক্ষিণ গেট দিয়ে বের হয়ে একটু যেতেই বিডিআর সদস্যরা তাঁদের গুলি করে হত্যা করেন। পিলখানার বিভিন্ন কোত থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে বিদ্রোহীরা গোটা পিলখানায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। দরবার হল থেকে পশ্চিম গেট দিয়ে বের হয়ে রাস্তার পাশে পৌঁছলে ৮-১০ জন সেনা কর্মকর্তাকে প্রথমে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে ও শুইয়ে রাখেন বিদ্রোহীরা। এরই মধ্যে একটি পিকআপে সিপাহি রমজান ১৫ ব্যাটালিয়নের সঙ্গীদের নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন এবং তাঁর হাতে থাকা এসএমজি দিয়ে ব্রাশফায়ার করে তাঁদের হত্যা করেন।সিপাহিদের নির্দেশ মেনে মহাপরিচালক শাকিল আহম্মেদ লাইনের আগে এবং অন্য সেনা কর্মকর্তারা তাঁর পেছনে পেছনে দরবার হলের পশ্চিম গেটের দিকে যেতে থাকেন। দরবার হলের বাইরে দু-তিন পা অগ্রসর হওয়া মাত্র বিদ্রোহীরা ব্রাশফায়ার করে তাঁদের হত্যা করেন। তাঁদের সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র লুটপাট করেন। হত্যার আগে বিদোহীরা সেনা কর্মকর্তাদের লাথি, ঘুষি মারেন এবং বেয়নেট চার্জ করেন।এভাবে বিদ্রোহীরা দরবার হল ও আশপাশের এলাকায় ৪৫ জন কর্মকর্তাকে হত্যা করেন। তিন সেনা কর্মকর্তা দরবার হলের উত্তর দিকে কাচ ভাঙা অংশ দিয়ে পালিয়ে মাঠ ও মাঠের পরে রাস্তা পার হয়ে একটি পানির ট্যাংকের ঘরে ঢুকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন; কিন্তু বিদ্রোহীরা সেখানে গিয়ে তাঁদের হত্যা করেন। মেজর হুমায়ুন কবির দরবার হলের দক্ষিণে রাস্তার ওপর ডিজির গাড়িতে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করেন। তাঁকে সেখানে গুলি করে হত্যা করা হয়। বিদ্রোহীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে সুবেদার কাশেম দরবার হলের দক্ষিণ পাশে মারা যান। বিদ্রোহীদের গুলি, বোমার বিস্ফোরণে পিলখানার আশপাশের কয়েকজন পথচারী, একজন রিকশাওয়ালাও নিহত হন। তাঁরা একপর্যায়ে ডিজির স্ত্রী, বাসায় থাকা দুই মেহমান ও গৃহকর্মীকে হত্যা করেন। সেনা কর্মকর্তাদের বাসায় ব্যাপক লুটপাট হয়। সেনা পরিবারের সদস্যদের নির্যাতনও করা হয়।রায় কার্যকরের অপেক্ষায় স্বজনরা : বিডিআর বিদ্রোহের হত্যা মামলার রায় ঘোষণার পর ওই দিনের ঘটনায় নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এখন অপেক্ষা করছে রায় কার্যকরের জন্য। ইতিমধ্যে আদালতের রায়ে যাঁরা সাজাপ্রাপ্ত তাঁরা আপিল করেছেন। ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানিও হবে হাইকোর্টে। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, আপিল ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি একই সঙ্গে হবে। এত বিপুলসংখ্যক আসামির আপিল শুনানিতে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। এ কারণে এ মামলার শুনানিতে জরুরি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন অনেকে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন