যেকোনো দেশেই নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কোনো কোনো নির্বাচন অন্য নির্বাচনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। দেশের অভ্যন্তরীণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক নীতিমালা যখন পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়, দেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্ন নিয়ে যখন সাধারণ মানুষের মধ্যে বড় রকমের মতভিন্নতা দেখা দেয় কিংবা যখন সমাজে নতুন সামাজিক/রাজনৈতিক শক্তির অভ্যুদয় ঘটে, তখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন এবং তার ফলাফলের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে গত ২২ বছরে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনকেই আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করেছি। দেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলো একে তাদের জীবন-মরণের প্রশ্ন বলে হাজির করেছে। এটি একটি বিরল ঘটনা। খুব কম দেশই রয়েছে, যেখানে আমরা এ ধরনের পরিস্থিতি দেখতে পাই। এরই ধারাবাহিকতায় আসন্ন নির্বাচনের বিষয়কেও সেভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার কারণ হলো গণতন্ত্রায়ণের পথে বাংলাদেশের অবস্থান। কিন্তু এ ধরনের গুরুত্ব সত্ত্বেও যে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে, তার পেছনে আছে নির্বাচন বিষয়ে সমাজে ও রাজনীতিতে সৃষ্ট মানসিকতা।
নির্বাচন হলো কারা ক্ষমতায় যাবে, তা নির্ধারণের পথ। বাংলাদেশে দলগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক, তা যেমন কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ঠিক, তেমনি স্থানীয় পর্যায়ে। এর ফলে দলের নেতা এবং কর্মীর সম্পর্ক হলো পেট্রন এবং ক্লায়েন্টের বা সুবিধা প্রদানকারী এবং সুবিধা গ্রহীতার। রাষ্ট্রক্ষমতার প্রয়োজন হয় সেই সম্পর্ককে বহাল রাখার জন্য, আর্থিক এবং অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশে এযাবৎ যে তিনটি দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, তারা সবাই রাষ্ট্রীয় সম্পদকে দলীয়ভাবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে একে অন্যকে ছাড়িয়ে গেছে। আর্থিক দুর্নীতি যে প্রতিটি শাসনামলেই বৃদ্ধি পেয়েছে, তার একটা অন্যতম কারণ এখানে লুকানো। কিন্তু একে কেবল আর্থিক বিষয় বলে বিবেচনা করলেই হবে না। আমরা এও দেখেছি যে ক্ষমতাসীন দলগুলো তাদের সমর্থকদের আইনের হাত থেকে অবৈধভাবে সুরক্ষা করেছে। ফলে যাঁরাই ক্ষমতায় গেছেন, তাঁরা ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা বিবেচনা করতে পারেননি। তাঁরা নির্বাচনের ফলাফলের রাজনৈতিক যে ক্ষতি, তার চেয়ে বেশি বিবেচনায় নিয়েছেন নির্বাচন-উত্তরকালে তাঁদের ব্যক্তিগত এবং তাঁদের সমর্থকদের নিরাপত্তা নিয়ে। বাংলাদেশে যে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আদর্শিকভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকার কারণ নেই। অতীতে নির্বাচনে পরাজিত হয়ে তাঁরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাননি। কিন্তু আমরা এও দেখেছি যে নির্বাচনের পর দুর্নীতির বৈধ অভিযোগ থেকে শুরু করে অন্যান্য অকিঞ্চিৎকর কারণে তাঁরা নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তাঁদের ওপরে খড়্গের মতো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন রকমের অভিযোগ। নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে যত মামলা দেওয়া হয়েছে, তার কিয়দংশেরও বিচার সম্পন্ন করা হয়নি। এগুলোকে বিভিন্নভাবে ব্যবহারও করা হয়েছে। ফলে রাজনৈতিক দলের কাছে মনে হয়েছে যে রাজনৈতিকভাবে হেনস্তা না হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া বা ক্ষমতায় থাকা। সে কারণেই আমরা দেখতে পাই যে ক্ষমতার প্রশ্নটি একটা ‘জিরো-সাম’-এর (সবকিছু বা কিছু না) খেলায় পরিণত হয়েছে।
গত দুই শাসনামলে এই পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। তার কারণ, বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটির সদস্যরাও এখন এই সুবিধার অংশীদার হয়েছেন বা আদর্শিকভাবে সমর্থনের নামে দলগুলোর ভাগ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছেন। তাঁরা এও দেখেছেন যে দলীয় নেতা-কর্মীদের মতো তাঁদের ভাগ্যও দলের ক্ষমতায় থাকা না-থাকার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। সেটা যতটা না আর্থিক, তার চেয়ে বেশি ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং সামাজিক অবস্থানের প্রশ্নে। ফলে তাঁরাও নির্বাচনে বিজয়কে একধরনের অস্তিত্বের প্রশ্ন বলে বিবেচনা করছেন। গত পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে সম্পর্ক এতটাই বৈরী হয়ে পড়েছে যে এ ধরনের আশঙ্কার কারণকে বাস্তব বলেই তারা মনে করছে। গত কয়েক বছরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্ন, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তি, বিশেষত হেফাজতে ইসলামের উত্থান প্রশ্নে মতভিন্নতা। এ ক্ষেত্রে যাঁরা দেশে রাষ্ট্র এবং ধর্মের একটা সুস্পষ্ট বিভাজন দেখতে চান, যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বলে পরিচিত, তাঁরা উদ্বিগ্ন যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে তাঁদের আদর্শিক পরাজয়ই শুধু ঘটবে তা নয়, দেশের রাজনীতির গতিমুখ হয়ে পড়বে ধর্মভিত্তিক। তাঁদের এই আশঙ্কার কারণ বিএনপির গত শাসনামলে (২০০১-০৬) ক্ষমতায় জামায়াতে ইসলামীর প্রভাবশালী উপস্থিতি, দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ও সরকারের অভ্যন্তরে তার প্রতি সমর্থন। এ বিষয়ে দেশের নাগরিকদের আশ্বস্ত করতে যে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার প্রতিশ্রুতি কতটা আন্তরিক, কতটা অতীত থেকে শিক্ষার ফল এবং কতটা নির্বাচনী কৌশল, তা স্পষ্ট নয়। দেশের একটি প্রধান দল এ বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে না পারলে কেবল নির্বাচনেই গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের প্রশ্ন মীমাংসা হবে না।
যেকোনো ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতা থেকে অপসৃত হওয়ার যেসব শঙ্কায় থাকে বলে আমি আগে উল্লেখ করেছি, আওয়ামী লীগের জন্য তার চেয়েও বেশি শঙ্কার কারণ তৈরি হয়েছে। গত পাঁচ বছরে তার কর্মী ও নেতারা যে ধরনের আচরণ করেছেন, শাসনের ক্ষেত্রে তাঁদের যেসব ব্যর্থতা রয়েছে, সেগুলো এই কারণ তৈরি করেছে; তার অতিরিক্ত হিসেবে তাঁরা সম্ভবত ভাবছেন বিএনপির বৈরী আচরণ কতটা আক্রমণাত্মক হবে। ইতিমধ্যে জামায়াতের সহিংসতা যদি কোনো ইঙ্গিত বহন করে, তবে তা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির জন্যও আশঙ্কাজনক। কিন্তু তার পাল্টা পদক্ষেপ নিলে তাতে দেশের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। বিপরীতক্রমে ক্ষমতার বাইরে সাত বছর ধরে থাকার পর বিএনপির পক্ষে আরও এক মেয়াদ বাইরে থাকার ভীতি কাজ করছে। সেটা যেমন সাংগঠনিক ক্ষতির বিবেচনায়, তেমনি তাদের বিরুদ্ধে সরকারের আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশঙ্কায়। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে তার বিবেচনায়ও। জামায়াতে ইসলামী কার্যত অস্তিত্বের লড়াইয়ে ব্যাপৃত। তাদের আরও পাঁচ বছর ধরে এই লড়াই চালাতে আগ্রহী হওয়ার কারণ নেই। তারা নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলেও তাদের আশা যে তাদের প্রতি বৈরী নয় এমন সরকার ক্ষমতায় আসা দরকার।
বাংলাদেশের সমাজে এখন এমন এক পরিস্থিতির সূচনা হয়েছে, যেখানে নির্বাচনের প্রশ্নে নির্বাচনের পরের অবস্থাই এখন প্রধান বিবেচ্য হয়ে পড়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে এগুলো বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলো নির্বাচনের চেয়ে নির্বাচনের পরে তাদের, তাদের সমর্থক এবং সহানুভূতিশীলদের নিরাপত্তা ও অস্তিত্বের প্রশ্নেই বেশি উদ্বিগ্ন। দেশের এবং দেশের বাইরের যাঁরাই নির্বাচনের বিষয়ে তাগিদ দিচ্ছেন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার ওপর জোর দিচ্ছেন, সবার অংশগ্রহণের কথা বলছেন। তাঁদের এটা উপলব্ধি করার সময় এসেছে যে নির্বাচন-উত্তর ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলের সম্পর্কের বিষয়ে কোনো রকম মীমাংসা না করে নির্বাচনকে সুষ্ঠু করা যেমন অসম্ভব, তেমনি নির্বাচন অনুষ্ঠানই বর্তমান সংকটমোচনের পথ নয়।
আলী রীয়াজ: পাবলিক পলিসি স্কলার; উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারস, ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্র।
Share on Google Plus

About juwel ishlam

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
    Blogger Comment