ইতিহাসের খাতায় নাম লেখলেন সোহাগ গাজী

GAZI-SUCCESSFUL-APPEL-AGAINST-FULTON-1
শুধু নাটকীয় কিছু হলেও চলবে না। হতে হবে মহানাটকীয় কিছু। তাহলেই যদি এই টেস্টে ড্র ছাড়া অন্য কিছু হয়। শেষ দিনের খেলা যেন নিস্তরঙ্গ নদী। এই খেলা না দেখলেও চলে।
তা নিস্তরঙ্গ নদীও তো কখনো কখনো রূপ বদলায়। তাতে ‘তরঙ্গ মিলায়ে যায়, তরঙ্গ ওঠে।’ লাঞ্চের পর হঠাৎই যেমন তরঙ্গায়িত রূপে আবির্ভূত মরা এই খেলা। ম্যাচের বৃহত্তর ছবিটা তাতে বদলাল না। কিন্তু ‘এই খেলা দেখে কী লাভ’ ভেবে যাঁরা মাঠ থেকে দূরে রইলেন, টেলিভিশন থেকে চোখ সরিয়ে, তাঁদের সঙ্গী হয়ে গেল অনন্ত আফসোস। ইতিহাস তো আর সবাই গড়তে পারে না, তবে ইতিহাসের সাক্ষী থাকাটাও বাকি জীবন গল্প করার রসদ। জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামে উপস্থিত হাজার কয়েক দর্শক এমন এক ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে গেলেন, ১৩৬ বছর বয়সী টেস্ট ক্রিকেট যা আগে কখনো দেখেনি।নিউজিল্যান্ড ইনিংসের ৮৫তম ওভার। সোহাগ গাজীর ২৪তম।l দ্বিতীয় বলে কোরি অ্যান্ডারসন এলবিডব্লু।
l পরের বলে ওয়াটলিং ক্যাচ দিলেন মুশফিকুর রহিমকে। বুকে বল লাগার পর দু-তিনবারের চেষ্টায় যা তাঁর গ্লাভসবন্দী হলো।মুশফিকের বুকের পরিচর্যায় কিছুক্ষণ বন্ধ থাকল খেলা। হ্যাটট্রিকের সামনে দাঁড়ানো সোহাগ গাজীর কি অনন্তকাল মনে হচ্ছিল সময়টাকে!
l চতুর্থ বলে ব্রেসওয়েলও ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে। মুশফিকের প্যাডে লেগে সেটি শূন্যে। লেগ স্লিপ থেকে দৌড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডান হাতে অসাধারণ এই ক্যাচ নিলেন সাকিব।
হ্যাটট্রিক!প্রতিজ্ঞায় শাণিত হয়ে কোনো বোলার ঘোষণা দিয়ে ৫-৬ উইকেটও পেয়ে যেতে পারেন। কিন্তু হ্যাটট্রিক তো বলেকয়ে হয় না। বোলিং-দক্ষতা তো লাগেই, তবে তার চেয়ে বেশি লাগে ভাগ্য। যে কারণে ২০৯৭ নম্বর টেস্টে মাত্র ৪০তম হ্যাটট্রিক। উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য এটিই যথেষ্ট। পুরো দলের মধ্যমণি হয়ে সেই উচ্ছ্বাসেই ভাসছিলেন সোহাগ গাজী। বাংলাদেশের পক্ষে যে তিনি প্রথম নন, এটি জানতেন। টেলিভিশনে ‘লাইভ’ দেখেননি, তবে জানা ছিল, ২০০৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে পেশোয়ারে সেই কীর্তির গর্বিত অধিকারী হয়ে গেছেন অলক কাপালি। কিন্তু আরেকটি জায়গায় যে টেস্ট ইতিহাসেরই ‘প্রথম’ হয়ে গেছেন, এটি সোহাগের জানা ছিল না। জানা ছিল না বাংলাদেশ দলের কারোরই। সোহাগ গাজী সেটি জানলেন সংবাদ সম্মেলনে এসে।জানলেন, একটু আগে যা করেছেন, সেটি ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায়। প্রথম অধ্যায় রচিত হয়েছে আগের দিনের সেঞ্চুরিতে। কত রথী-মহারথীর চরণচিহ্নে রঙিন হয়েছে টেস্ট ক্রিকেট, কত তাঁদের কীর্তিগাথা! কিন্তু একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও হ্যাটট্রিক আর কারও নেই। এই গৌরব শুধুই বাংলাদেশের অফ স্পিনারের।
শুধু অফ স্পিনার বলবেন? এমন অভূতপূর্ব এক অলরাউন্ড কীর্তির পর সোহাগ গাজীকে অলরাউন্ডার না বলে কি উপায় আছে কোনো! যে কীর্তি চট্টগ্রাম টেস্টের নিস্তরঙ্গ শেষ দিনে এমনই এক তরঙ্গ তুলল, যেটি ছড়িয়ে গেল ক্রিকেট ইতিহাসজুড়ে।ম্যাচের বাকি সব তুচ্ছ হয়ে গেল এটির পাশে। ৭ উইকেটে ২৮৭ রান তুলে দ্বিতীয় ইনিংস ঘোষণা করেছে নিউজিল্যান্ড। কমপক্ষে ৪৬ ওভারে (শেষ পর্যন্ত হয়েছে ৪৮.২ ওভার) ২৫৬ রানের প্রায় অসম্ভব চ্যালেঞ্জের পেছনে ছোটার কোনো কারণই ছিল না বাংলাদেশের। ম্যাচ তাই শেষ হয়েছে ম্যাড়মেড়ে ড্রয়ে।খেলা শেষ হওয়ার অনেক আগেই জয়-পরাজয়ের সম্ভাবনা শেষ। ম্যাড়মেড়ে ড্র-ই তো! কিন্তু টেস্ট শেষ হওয়ার প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর ম্যাচ রিপোর্টের এই জায়গায় এসে ‘ম্যাড়মেড়ে’ শব্দটাকে কেটে দিতে ইচ্ছা করছে। যে ম্যাচ এমন ইতিহাসের সাক্ষী, সেটিকে কীভাবে এমন অপবাদ দেওয়া যায়!ক্রিকেটে রেকর্ডের শেষ নেই। কিন্তু এই রেকর্ড তো সব কল্পনাকে হার মানানোর মতো! আগের দিন আট নম্বরে নেমে সেঞ্চুরি, পরের দিন হ্যাটট্রিক! চরম কল্পনাবিলাসী ঔপন্যাসিকও তো তাঁর উপন্যাসের নায়ককে দিয়ে এটি করাতে গিয়ে ভাববেন, ‘ধেৎ, এতটা বাস্তবতাবিবর্জিত হওয়া যায় নাকি!’
হ্যাঁ, রূপকথায় সম্ভব। সোহাগ গাজী যেন সেই রূপকথা।ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর দিলেন এক-দুই শব্দে। স্বভাবগতভাবেই লাজুক নাকি ঘোর কাটছে না বলে সবকিছু স্বপ্ন-স্বপ্ন মনে হচ্ছে তাঁর!কিন্তু এমন একটা কীর্তি গড়ার পর সংক্ষিপ্ত ওই নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়ায় কি পাঠকের তৃষ্ণা মিটবে? হোটেলে ফেরার পর নিজের রুমে যাওয়ার পথে তাই থামানো হলো সোহাগ গাজীকে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কাঁধে ব্যাগ। চেহারায় পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচের ধকল। সেটি ছাপিয়ে খেলা করছে অদ্ভুত এক আলো। বাস্তবের হোক বা কল্পনার, হুমায়ূন আজাদের কবিতার পঙিক্তটি অবশ্যই প্রেমিকাকে নিয়ে লেখা। কিন্তু এদিনের সোহাগ গাজীর সঙ্গে অনায়াসে তা চালিয়ে দেওয়া যায়।


Share on Google Plus

About juwel ishlam

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
    Blogger Comment